১৯ বছর পরেও টাটকা সংসদ হামলার স্মৃতি

|| নয়ন রায় ||

আর পাঁচটা দিনের মত সেদিনটাও ছিল কর্মব্যস্ততা। ততদিনে কালবেলা প্রকাশিত হয়ে গেছে দিল্লি থেকে। হাতে কাগজ নিয়ে যখন ডিটিসির বাস থেকে  শাস্ত্রীভবনে নামলাম, ততক্ষণে বুঝলাম সামনে কিছু হয়ে গেছে। কিন্তু কি হয়েছে সেটা পরিস্কার না।

শাস্ত্রী ভবনের পাশেই কৃষিভবন। সেই ফুটপাতে যাদের দোকান তারা মালপত্র গুটিয়ে ছোটাছুটি করছে। ততক্ষণে গুলির আওয়াজ কানে এসছে। নিজেও হকচকিয়ে গেলাম। কি করব বুঝতে পারছিলাম না। তখন দিল্লিতে মেট্রোর কাজ শুরু হয়নি। আমার সেদিন কাজ ছিল রেলভবনে।

রেলভবনের মেন ফটক বন্ধ হয়ে গেছে। সবে একতলা উঠেছি। সিআরপিএফ ঘিরে ফেলেছে রেলভবন। তারা বলছেন পার্লামেন্টে আতঙ্কবাদী হামলা হয়েছে। সমস্ত জানলা দরজা বন্ধ। কিছুটা সাহস করে জানলা দিয়ে মুখ বের করে দেখলাম গুলি চলছে।

তখন দুপুর। প্রায় চারঘন্টা গুলির শব্দে কেঁপে ওঠে বিজয়চক, ইন্ডিয়া গেট সহ চারপাশ। স্তব্ধ দিল্লি। উদ্যোগ ভবন, নির্মান ভবন, বায়ুসেনাভবন, ডিফেন্সভবনের দখল নিয়েছে সেনা। এরকম গুলির আওয়াজ কোনোদিন শুনিনি।

সংসদ ভবনের ভিতরে থাকা গাছগুলি থেকে কাকপক্ষী উড়তে শুরু করেছিল। তাদের চিৎকার আকাশভেদ করে কানে আসছিল। চারঘন্টা ধরে চলে গুলির লড়াই। অতঃপর জঙ্গিদের নিকেশ করতে পেরেছিল দিল্লি পুলিশ। পুরো এলাকা কর্ডন করে দেওয়া হয়েছিল। ইন্ডিয়া রেড ক্রস সোসাইটি, বিপি হাউস, নর্থ অ্যাভেনিউ, পার্লামেন্ট স্ট্রিট।

তখন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী। কেন্দ্রে এনডিএ সরকার। সাউথ ব্লক থেকে বেরিয়ে এসে যে গেট দিয়ে প্রধানমন্ত্রী ঢোকেন সেই গেট দিয়েই অ্যাম্বাসাডর গাডিতে চেপে সন্ত্রাসবাদীরা ঢুকেছিল। পরে জানা যায় এই হামলার নেপথ্যে ছিল লস্কর-ই-তৈবা ও জইশ-ই-মহম্মদের জঙ্গি সংগঠন।

তাদের মূল লক্ষ্য ছিল সংসদ ভবন ও সেদিন ভবনে থাকা সাংসদরা। সংসদ ভবনের জঙ্গি নাশকতার খবর পৌঁছে যায় গোটা বিশ্বে তরঙ্গের মত। চারঘন্টা পর যখন রেলভবন থেকে ছাড়া পেলাম বেশ কিছুটা উৎসাহ নিয়ে পার্লামেন্টের দিকে এগোনোর চেষ্টা করছিলাম। কিন্ত নিরাপত্তা রক্ষীরা এগোতে দেয়নি।

http://sh103.global.temp.domains/~lyricsin/thequiry/tmc-terminate-suvendu-close-kanishka-panda/

তখনও জানা যায়নি, মৃতের সংখ্যা কত। কতজনই বা আহত হয়েছেন। দিল্লি পুলিশ ও সিআরপিএফ যেভাবে মোকাবিলা করেছিল, তাতে সংসদের ভেতর ওরা ঢুকতে পারেনি। রক্ষা পেয়েছিল সংসদ ভবন।

এই কান্ডে মাস্টারমাইন্ড ছিলেন আফজল গুরু। তাকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়। দীর্ঘদিন ট্রায়ালে রাখা হয় তাদের। পরে তার স্বীকারক্তিতো উঠে আসে কীভাবে অপারেশন হয়েছিল। দিল্লির কোন কোন জায়গায় রেইকি করে পরিকল্পনা করেছিল নাশকতার সবকিছুর। পরে আফজলগুরুর ফাঁসি হয়ে যায়।

আফজল যেহেতু কাশ্মীরের নাগরিকছিল, সেদিন তোলপাড় হয়েছিল কাশ্মীরও। সেদিনের গুলিতে ক্ষতবিক্ষত সংসদ ভবনের দেওয়ালের বেশ কিছু ইঁট চাঁই ভেঙে পড়েছিল। এখন সেই ক্ষতে প্রলেপ পড়লেও স্মৃতি এখনো টাটকা।

সেইসঙ্গে শহীদ বেদিতে যারা সেদিনের ঘটনায় শহীদ হয়েছিল তাদের নাম লেখা আছে। প্রতি বছর যখন এই দিনটি আসে প্রধানমন্ত্রী শ্রদ্ধা জানান সেই শহীদদের উদ্দেশে। তাই আত্মনির্ভর ভারতবর্ষের ঘোষণা যখন প্রধানমন্ত্রী করেন, ঠিক তখনই স্বাধীনতার পর তৈরী হওয়া সংসদভবন যা ২০০১ সালে কলঙ্কিত হয়েছিল তা অস্বীকার করি কী করে।

২০০১ সালে ১৩ ডিসেম্বর সকালেই ঘটেছিল জঙ্গিহানার ঘটনা। ৫ জঙ্গি সংসদ ভবনে অনুপ্রবেশ করে হামলা চালিয়েছিল। জঙ্গিদের গুলিতে রাজ্যসভার পার্লামেন্ট সিকিউরিটি সার্ভিসের ২ জওয়ান, সিআরপিএফের এক মহিলা কনস্টেবল, এবং দিল্লি পুলিশের ৫ জন শহিদ হয়েছিলেন।

তাই আত্মনির্ভর ভারতবর্ষকে আমরা যতবেশী মনে রাখব পাশাপাশি ২০০১ এর স্মৃতি কখনোই ভোলা যাবে না। একজন সাংবাদিক হিসাবে সেই ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিলাম আমি। কোনো গল্প কথা নয়, যা দেখেছি আজ ১৯ বছর পর সেই স্মৃতি তুলে ধরলাম।

সম্পর্কিত পোস্ট