রাজনীতি এখন ইভেন্ট নির্ভর, নিখোঁজ জনগণের মৌলিক অধিকারের প্রশ্ন
||দিলীপ রায় ||
নির্বাচনে জিতে ক্ষমতা দখলই টার্গেট। আর এই টার্গেট ছুঁতে ভোটারের মন জয়ে লোভনীয় ইভেন্ট এখন অন্যতম হাতিয়ার। জনগণের মৌলিক অধিকার সেখানে উপেক্ষিত। ভোটকে নজরে রেখে সেই হাতিয়ারে সময় মতো শান দেয় সংসদীয় রাজনৈতিক দল।
রাজ্যে পুর ভোটের মুখে তেমনই এক ইভেন্ট নিয়ে হাজির বিজেপির নাম্বার টু নেতা, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। রবিবার শহিদ মিনার ময়দানে তিনি দলের নয়া ইভেন্ট ‘আর নয় অন্যায়’-এর সূচনা করেন।
রাজ্যের শাসকদল তৃণমূলের বিরুদ্ধে তোলাবাজি, সিন্ডিকেটরাজ, দুর্নীতির অভিযোগ তোলেন। আর একটি মোবাইল নাম্বার দিয়ে দাবি করেন, ওই নাম্বার ডায়াল করলেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করা যাবে। তাঁর আহ্বান, নিজের লোক-আত্মীয়স্বজন সবাইকে একবার ডায়াল করতে বলুন, মোদির হাত শক্তিশালী করুন। বামেদের ৩৪ বছর-তৃণমূলকে ১০ বছর দিয়েছেন,দেখেছেন। বিজেপিকে একবার দিন, সোনার বাংলা গড়ে দেব। তোলাবাজ, দুর্নীতিবাজদের জেলে পাঠাব।
আরও পড়ুনঃ ক্ষমতায় কে? বিরোধীই বা কারা?
গত লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যের ৪২ আসনের ১৮টি দখলের পর তৃণমূল ‘দিদিকে বলো’ ইভেন্ট চালু করে। এদিন ‘দিদিকে বলো’ ইভেন্টকে কটাক্ষ করেন অমিত। কটাক্ষ করেন পরিবারবাদকেও।
এ রাজ্যে কোনও রাজপুত্রের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ নেই বলেও উল্লেখ করেন। তার বক্তব্যে কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা বিলোপ, রামমন্দির, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বা সিএ এ, কেন্দ্রীয় প্রকল্প প্রয়োগে রাজ্যের অসম্মতির প্রসঙ্গ এলেও সাধারণের রুটি-রুজির প্রসঙ্গ, কর্মসংস্থানের প্রসঙ্গ আসেনি।
এভাবেই ইভেন্ট রাজনীতিতে দলীয় এজেন্ডার বাইরে উপেক্ষিত হচ্ছে সাধারণের মৌলিক অধিকারের প্রশ্ন।
নজর কেবলমাত্র পুর নির্বাচনই নয়, ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনের দিকে পাখির চোখ শাসকদল এবং প্রধান বিরোধী শক্তির। সেই মতো গুটি সাজাচ্ছে তৃণমূল ও বিজেপি। ভোটযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করেছে বাম- কংগ্রেসও। যদিও শাসক তৃণমূল বা প্রধান বিরোধী শক্তি বিজেপির থেকে তারা অনেক পিছিয়ে রয়েছে।
রাজ্য দখলের পথ প্রশস্ত করতে শহরে এদিন পক্ষান্তরে নির্বাচনি প্রচার শুরু করেন অমিত। তৃণমূলের বিরুদ্ধে স্বজনপোষণ,দুর্নীতি ও পঞ্চায়েত নির্বাচনে সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলে লোকসভা নির্বাচনে সাফল্য পায় বিজেপি।
অমিত শাহের ২২ আসনের টার্গেট না ছুঁতে পারলেও ১৮ আসন দখল করে গেরুয়া শিবির। বিস্তীর্ণ অঞ্চলে জমি হারানোর পর ভোটকুশলি প্রশান্ত কিশোরের ইন্ডিয়ান পলিটিক্যাল অ্যাকশন কমিটি (আই-প্যাক)-এর হাত ধরে তৃণমূল। রাজ্য জুড়ে শুরু হয় ‘দিদিকে বলো’ ইভেন্ট। যে কোনও মানুষকে সরাসরি অভিযোগ জানানোর সুযোগ দেয় এই ইভেন্ট। এর মাধ্যমে সাধারণ ভোটারকে সরাসরি নাড়া দিতে সক্ষম হয় তৃণমূল।
বেশ খানিকটা জনভিত্তিও ফিরে পায়। ‘দিদিকে বলো’তে প্রথম ৩০ দিনে ১০ লক্ষ অভিযোগ পায় দল। দলের সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন জানান, ‘দিদিকে বলো’তে বিপুলসংখ্যক মানুষের সাড়া পেয়ে আমি অভিভূত। অনেক মূল্যবান প্রস্তাব ও অভিযোগ পেয়েছি। অতিরিক্ত সময় কাজ করে এইসব প্রস্তাব ও অভিযোগ নিয়ে ব্যবস্থা নেব।
এরপরে রাজ্যের বিধানসভা উপনির্বাচনে ৩-০ ফল করে তৃণমূল। বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের খড়্গপুর আসনও ছিনিয়ে নেয়। যদিও পরিস্থিতি আগের থেকেও ভাল হলেও নিশ্চিন্ত নন মমতা।
আরও পড়ুনঃ ২১ এর খোলা চ্যালেঞ্জ, মোকাবিলা করতে পারবেন তো মুখ্যমন্ত্রী?
সূত্রের খবর, জনমত যাচাই বা জনমত বৃদ্ধিতে এবং ভোটারের মনজয়ের কৌশল রচনায় তাই পিকের টিমের উপর অনেকটাই নির্ভরশীল তিনি। ফলে পিকের পরামর্শে ‘২১-এর নির্বাচনকে পাখির চোখ করে নয়া ইভেন্টে কাজ শুরু করতে চলেছে দল।
জানা গিয়েছে, এবারের ইভেন্ট ‘আমাদের গর্ব মমতা’। সম্প্রতি আইপ্যাকের এক কর্মকর্তা সংবাদমাধ্যম ‘দ্য ওয়ার’কে জানান, এই ইভেন্টের মাধ্যমে দলের বিধায়ক ও বিধানসভা ভোটের সম্ভাব্য প্রার্থীরা নিজেদের কেন্দ্রে ১৫ দিন মাটি কামড়ে পড়ে থাকবেন। ওই ক’দিনে ওই কেন্দ্রের অন্তর্ভুক্ত পুরসভা বা পঞ্চায়েতের কমপক্ষে ৪৫ ওয়ার্ডে ঘুরবেন তিনি। বাড়ি বাড়ি প্রচার করবেন, সভা করবেন। যতদূর খবর ২ মার্চ সোমবার এই ইভেন্টের সূচনা হবে এবং ৮ মার্চ থেকে পুরোদমে কাজ শুরু হয়ে যাবে।
অমিতের ‘আর নয় অন্যায়’ বা তৃণমূলের ‘আমাদের গর্ব মমতা’ ইভেন্টে সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকারের প্রশ্ন কিন্তু উপেক্ষিতই থাকছে। ‘মোদি’ বা ‘মমতা’ ব্র্যান্ডকে জনপ্রিয় করে ভোটবাক্সে এর প্রতিফলনকেই দাবি করছে এইসব ইভেন্ট।
একসময় ভোটে গরিবি ছিল সংসদীয় রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান হাতিয়ার। বামেরা মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রশ্নগুলোকে রেখে ভোট করত। রোটি, রোজি আউর মকান বা রুটি,রুজি, বাসস্থানের দাবি উঠত। দাবি উঠত বিজলি, পানি, সড়ক বা আলো, জল, রাস্তার। সেসবও ক্রমশ ব্রাত্য হয়ে গিয়েছে। যে সময় দেশে বেরোজগারি সাত দশকের শীর্ষে পৌছেছে, ঠিক তখন ভয়াবহ এই সমস্যা নিয়ে তেমন কোনও উদ্যোগ নেই।
ভোটে ইস্যু হয়, অনেক কর্মসংস্থানের দাবিও করা হয়, কিন্তু বাস্তব ছবি ভিন্ন কথা বলে। একটু চোখ খোলা রাখলেই দেখা যায়, যতটুকু কর্মক্ষেত্র রয়েছে দেশে, সেখানেও কাজের কোনও গ্যারান্টি নেই। উপযুক্ত পারিশ্রমিক থেকে বঞ্চিত কর্মীরা।
কেন্দ্র ও রাজ্য হরেকরকম সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প ও স্বনির্ভর প্রকল্পের সুবিধা বিলিয়ে উপভোক্তাদের মন জয় করে বা সংশ্লিষ্ট দলকে ভোট দিতে বাধ্য করে।
আরও পড়ুনঃ EXCLUSIVE: গোটা দেশজুড়ে যা চলছে তা একেবারে কাম্য নয়ঃ ইউসুফ তারিগামি
আর এভাবেই অনুদান নির্ভর রাজনীতির মাধ্যমে ‘পাঁচ ট্রিলিয়ন অর্থনীতি’র দিকে এগিয়ে যায় দেশ। উপেক্ষিত থেকে যায় আমজনতার মৌলিক অধিকারের দাবি।