ক্ষণজন্মা…
পার্থপ্রতিম বিশ্বাস, সম্পাদক, পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি
জাতীয় কংগ্রেস দলের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর থেকেই “প্রণববাবু” বা “প্রণব মুখার্জি” নামটা আমার হৃদয়ে অদ্ভুত একটা শ্রদ্ধা জাগায়। মানুষটা কিভাবে নিজেকে এতটা উচ্চতায় প্রতিষ্ঠা করেছেন তা আগামীদিনে গবেষণার বিষয়ও হতে পারে। “বেঁটে লোকেদের বুদ্ধি বেশী” বলে একটা প্রবাদ চালু আছে। উদাহরণ হিসাবে প্রথমেই যে নামটা আসে সেটা হলো, হিটলার। এরপরে পরপর আরও অনেক নাম, যেমন- মহাত্মা গান্ধী, সুনীল গাভাসকর বা শচীন তেন্ডুলকর। তবে বেঁটেরাই শুধু বুদ্ধিমান, এটা কিন্তু ঠিক নয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জওহরলাল নেহেরু, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, খান আব্দুল গফ্ফর খান, ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন, বিধান চন্দ্র রায়, এঁরা তো সকলেই লম্বা এবং নিজেদের শিক্ষা, মেধা ও সুকর্মের জন্য সর্বজনবিদিত। তবুও বেঁটেদের নিয়ে চালু প্রবাদটা আজও আছে। মাননীয় শ্রী প্রণব মুখার্জি সেই মহান বেঁটেদেরই একজন যিনি শরীর বাদে বাকী সব ক্ষেত্রেই মহিমা ও উচ্চতায় অনেক তালগাছকেও হারিয়ে দিয়েছেন।
শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী একবার বলেছিলেন, “প্রণবের মাথায় হাতুড়ি পেটালে ধোঁয়া বের হবে কিন্তু একটাও কথা বের হবে না (তখন প্রণববাবু পাইপ খেতেন)।” একজন স্কুল শিক্ষক হিসাবে কর্মজীবন শুরু করা এক ব্যাক্তি যেভাবে নিজেকে তাঁর শ্রম, অধ্যাবসায় ও দক্ষতা দিয়ে দেশের রাষ্ট্রপতি পদ পর্যন্ত উন্নীত করেছেন, সেটা মোটেও সহজ কথা নয়।
মনে আছে, ১৯৮৪ সালের এপ্রিল বা মে মাস নাগাদ হাওড়া কর্পোরেশন নির্বাচনে তৎকালীন ওই জেলার কংগ্রেস সভাপতি শ্রী অমিয় দত্তর (পাল্টুদা) নেতৃত্বে প্রণববাবুকে একটা সাধারণ হুডখোলা জিপে চড়িয়ে আমরা প্রচারে বেরিয়েছিলাম। একসময় সে জিপের তেল শেষ হয়ে গেলো। অথচ প্রচার তখনও বাকী। আমরা ওনাকে বললাম, আপনি জিপেই দাঁড়িয়ে থাকুন, আমরা জিপ ঠেলে নিয়ে যাচ্ছি। রাজী হননি, পরে তেল এনে তারপর প্রচার শুরু হয়। সে সময়ে “কন্টেসা” নামে একটা গাড়ী বেরিয়েছিলো। মিছিলের শেষে প্রণববাবু বিস্কুট রঙের একটা কন্টেসা চেপেই কলকাতায় ফিরে যান।
বরাবরই কেন্দ্রীয় সরকারের উচ্চতর পদে থাকলেও প্রণববাবু কোনোদিনও জননেতা ছিলেন না। ফলে তাঁকে দেশের বিভিন্ন রাজ্য থেকে জিতে রাজ্যসভার সদস্য হতে হয়েছে। ২০০৪ সালেই জীবনে প্রথমবার উনি জঙ্গিপুর লোকসভা আসন থেকে জিতে লোকসভার সদস্য হন।
এহেন মানুষটার বিরুদ্ধে বাঙালীদের এক বিরাট অংশের অভিযোগ, তিনি বাঙালী হওয়া স্বত্তেও বাংলার জন্য কিছুই করেননি। এটাও ঠিক যে, মন্ত্রীত্বের অধিকাংশ সময় অর্থ দপ্তরে কাটানো মানুষটার কাজ ছিলো বাকী দপ্তরগুলো যাতে ভালোভাবে কাজ করতে পারে সেজন্য অর্থের বরাদ্দ করা। ওনার বরাদ্দ করা অর্থ দিয়েই তো বাকী দপ্তর ও তার মন্ত্রীরা কাজ করেছেন এবং সেসবের প্রচারও করেছেন। তাহলে ওনার পক্ষে আলাদা করে আর কিইবা করা সম্ভব ছিলো? বসিরহাটের সংগ্রামপুরে নদীর ওপরে ব্রীজটা অথবা মালদার রতুয়ায় গঙ্গার ওপর যে ব্রীজ হয়েছে সেগুলো কিন্তু প্রণববাবুর উদ্যোগই তৈরী। শালবনির টাঁকশাল অথবা কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি যাওয়ার ফোরলেন রাস্তার জন্য অর্থ বরাদ্দ, দেশ জুড়ে হাজার হাজার এটিএম ও সরকারী ব্যাঙ্কের শাখা খোলা, জঙ্গিপুর লোকসভা এলাকায় ভারতী মিত্তাল গোষ্ঠীর দ্বারা পরিচালিত দশখানা বিনা পয়সার ইংরেজি মাধ্যম স্কুল, মুর্শিদাবাদে ওই জেলা সহ আসপাশের জেলাগুলোর যুবকদের সেনাবাহিনীতে চাকরী পাওয়ার সুবিধা করে দিতে রিক্রুটমেন্ট অফিস সহ আরও হাজারও কাজের সঙ্গে “প্রণব মুখার্জি” নামটা জড়িয়ে আছে।
এছাড়াও জাতীয় কংগ্রেস দলের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণ কমিটি থেকে শুরু করে দেশের অসংখ্য মন্ত্রী গোষ্ঠীর প্রধান পদে থাকা, এমনকি ভারতবর্ষ বাদেও বহু দেশের বাজেট তথা অর্থনীতি নিয়ে সেইসব দেশের সরকারকে সুপরামর্শ দেওয়াটাও ছিলো প্রণববাবুর নিত্যদিনের কাজ। মনে রাখবেন, ওনারও কিন্তু আপনার আমার মতোই ২৪ ঘন্টায় এক দিন হতো!
১৯৯১ সালে শ্রী নরসীমা রাও যখন দেশের প্রধানমন্ত্রী, ডঃ মনমোহন সিং দেশের অর্থ মন্ত্রী, প্রণববাবু তখন দেশের যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান। উত্তর ২৪ পরগণার আতপুরে একটি ঘরোয়া সভায় একমাত্র আমিই ওনাকে প্রশ্ন করার সুযোগ পেয়েছিলাম। জানতে চেয়েছিলাম, সত্যিই কি ভারতবর্ষ জওহরলাল নেহেরুর মিশ্র অর্থনীতির নীতি থেকে সরে যাচ্ছে? সভায় উপস্থিত প্রায় ৫০০ জনের সবাইকে চমকে দিয়ে উনি আমার পিঠ চাপড়ে বলেছিলেন, “দারুণ প্রশ্ন করেছো”। তারপর উত্তরটা দিয়েছিলেন। আজও কোথাও ওনার বলা সেই উত্তরটা বলতে হলে, আমি প্রণববাবুর নামটা বলেই কথাটা বলি।
১৯৯৪ সালের ১৪ই এপ্রিল ছিলো ১লা বৈশাখ। ওইদিন বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার আয়োজনে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি (সেসময়ে সেটাকে গ্যাট চুক্তি বলা হতো) সাক্ষরিত হয়। ভারতবর্ষের তরফে সেই চুক্তিতে সাক্ষর করেন শ্রদ্ধেয় শ্রী প্রণব মুখার্জি। মনে আছে, সেইসময়ে বামেরা সেই চুক্তির বিপক্ষে প্রবল প্রচার করেছিলো। ওদিকে চুক্তির সমর্থনে বিস্তারিত জানিয়ে প্রণববাবুও একটি বই ও একটি ক্যাসেট রেকর্ড করে দিয়েছিলেন। সেসময়ে প্রায়ই আমি ওনার লেখা সেই বইটা পড়তাম আর টেপরেকর্ডারে ক্যাসেটটি বাজিয়ে ওনার বলা কথাগুলো মুখস্থ করতাম। ফলে চেহারায় খর্বকায় হলেও, শিক্ষায় বুদ্ধিতে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় ওনার যে উচ্চতা ছিলো তা ছুঁতে একজন মানুষের যে কত জন্ম সাধনা করতে হবে, তার ইয়ত্তা নেই।
২০০৯ সালে জীবনের শেষবার উনি যখন দেশের অর্থমন্ত্রী হলেন, সেই সময়ের সংসদে প্রথম বাজেট পেশের আগের দিন সন্ধ্যায় আমরা কয়েকজন দিল্লিতে ওনার ১৩ নম্বর তালকোটরা রোডের বাড়িতে গিয়েছিলাম। এর আগে আমি মনেমনে ভাবতাম, দেশের অর্থমন্ত্রীর বাড়ী হয়তো সোনা দিয়ে বাঁধানো। নিদেনপক্ষে অতিব সুন্দর একটা বাড়ী তো হবেই। কিন্তু ১৩ নম্বর তালকোটরায় গিয়ে আমার চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেলো। আরে! এত সাধারণ? এর থেকেও সুন্দর এবং সাজানো বাড়িতো আমাদের এলাকাতেই গোটা দশেক আছে।
প্রণববাবু রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর ২০১২ সালের দুর্গাপুজোর সপ্তমীর দিন সকালে প্রথমবার ওনার গ্রামের বাড়ী কীর্ণাহারে যাই। একরাত কাটিয়েছিলাম ওনার ছেলে বাবুদা অর্থাৎ অভিজিৎ মুখার্জির আতিথেয়তায়। ওনার ক্লাব কিশোর সংঘ, বাড়ীর পাশের প্রাথমিক স্কুল থেকে জুবুটিয়ার শিব মন্দির, সব ঘুরে দেখেছি। দেখেছি, দেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতিকে সাদা ধুতি পাঞ্জাবী আর পায়ে সাধারণ একটা চটি পরে সাধারণ একটা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা সাধারণ মানুষের কথা শুনতে। দেখেছি, ভিআইপি থেকে গ্রামের সাধারণ গরীব মানুষ, সকলকেই ওনার বাড়ীতে পাশাপাশি বসে একইরকম খাবার খেতে।
প্রণববাবু জানতেন, উনি আড়াল থেকে যতই কাজ করুন, সরকারের নানান দপ্তরকে অর্থ জোগান দিয়ে যতই নতুন নতুন কাজ করতে উৎসাহিত করুন, জনতা মোটেও ওসব মানবে না। তারা চায় প্রণববাবু নিজে মুখে প্রচার করে বলুন, তিনি বাংলার জন্য কী কী করেছেন। কিন্তু প্রচারবিমুখ প্রণববাবু বরাবরই এসবের উল্টো পিঠে থেকেছেন। ফলে আজও এ বাংলার মানুষের একাংশের কাছে “অকাজের লোক” হয়েই আছেন, হয়তো থাকবেনও। মজার বিষয় হলো, এহেন প্রনববাবু তাঁর স্বমহিমায় না থাকার জ্বালা যে কতটা, সেটা ওনার চরম সমালোচকরা সহ পুরো দেশ আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।
উনি যখন রাষ্ট্রপতি হলেন সেই সময়ে আমি ওনাকে নিয়ে একটা কবিতা লিখে বাঁধিয়ে ওনার হাতে তুলে দিয়েছিলাম। শুনেছি, আমার সেই লেখাটা আজও ওনার ঢাকুরিয়ার বাড়ীতে আছে। যদি কখনও সুযোগ হয়, যদি কেউ সেটা একবারও পড়েন, জানবেন, আমার হৃদয়ে প্রণববাবু আসলে কি, তা ওই বারো লাইনের কবিতায় বলা আছে। মানুষটাকে নিয়ে দেশ তথা বিশ্বের বহু মানুষের অনেক কিছু বলার বা লেখার মতো এত কথা জমে আছে, যা দিস্তা দিস্তা কাগজ দিলেও শেষ হবেনা। প্রণববাবু মোটেও গান্ধীজীর মতো জননেতা, নেতাজী সুভাসচন্দ্রের মতো বিপ্লবী বা জওহরলাল নেহেরুর মতো দার্শনিক নন। তবে মন্ত্রী পদে থেকে প্রশাসনিক কর্তা হিসাবে দেশের প্রতি তাঁর অবদান কোনোদিনও ভোলার নয়।
এই মুহুর্তে অসুস্থ মানুষটি যখন দিল্লির হাসপাতালে শুয়ে জীবনের লড়াই লড়ছেন তখন অনেক দূরে বসে ওনার জন্য ঈশ্বরের কাছে কৃপা প্রার্থনা করা ছাড়া আমাদের আর কিইবা করার আছে। উনি সুস্থ হয়ে আবারও আমাদের মধ্যে ফিরে আসুন, এটুকুই চাইছি।
সবশেষে হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে শ্রদ্ধা জানিয়ে শুধু এটুকুই বলবো,
“ভেঙেছ দুয়ার এসেছ জোর্তিময়, তোমারই হউক জয়।”