ট্রেজারি বেঞ্চ থেকে ভরা পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে চণ্ডীর শ্লোক আওড়ালেন প্রণব মুখোপাধ্যায়, চমকে উঠলেন সাংসদরা

বীরেন ভট্টাচার্য, নয়াদিল্লি

কেন্দ্রে তখন কংগ্রেস সরকার। কেন্দ্রের মন্ত্রী তখন প্রণব মুখোপাধ্যায়। সেই সঙ্গে তিনি দলের ক্রাইসিস ম্যানেজারও বটে। সংসদে বিজেপি অভিযোগ তুলল কোন রাজ্যে স্কুলের পাঠ্য বইয়ে না কি লেখা রয়েছে হিন্দু দেব-দেবীরা সুরাপানে আসক্ত।

এই অভিযোগ তোলার পরেই হিন্দু ধর্মের স্বঘোষিত রক্ষাকর্তারা রে রে করে উঠলো। রীতিমতো নাজেহাল অবস্থায় ট্রেজারি বেঞ্চ। সেই সময় হঠাৎই দেখা গেল, সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে পরামর্শ করছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়।

নেত্রীর সবুজ সংকেত পাওয়ার পরেই, সংসদে দাঁড়িয়ে উদাত্ত কণ্ঠে চন্ডীপাঠ করলেন তিনি। শ্রীশ্রী চণ্ডীর তৃতীয় অধ্যায় থেকে মহিষাসুর বধ এর বর্ণনা দিলেন, এবং সেটির বাংলা তর্জমা করে যুক্তি দিলেন, মহিষাসুর বধের সময় দেবী দুর্গা সুরা পান করেছিলেন।

অতএব সেই কথা কোন পাঠ্যবইয়ের উল্লেখ থাকলে তা হিন্দু ধর্মের অবমাননা হতে পারে না। তার এই যুক্তির জাল শুনে, কংগ্রেস তো বটেই, চমকে গিয়েছিল বিজেপিও।

এই গল্পের অবতারণা করার কারণ, প্রণব মুখোপাধ্যায়ের একটি দিক তুলে ধরা। সেটি হল দলের ক্রাইসিস ম্যানেজার। পরমাণু চুক্তির সময় বামেদের সঙ্গে যে মতানৈক্য, সেই কাজে কংগ্রেসের হয়ে দৌত রক্ষা করেছিলেন তিনি।

ফলে, রাজনীতিবিদ হিসেবে, তাঁর সঙ্গে অনেকের মতনৈক্য থাকতেই পারে, তবে তিনি যে একটি প্রতিষ্ঠান ছিলেন এবং সেইসঙ্গে সর্বজনগ্রাহ্য ‘ক্রাইসিস ম্যানেজার’ ছিলেন একথা একবাক্যে সবাই স্বীকার করেন।

১৯৫৭ সালে স্নাতকোত্তর এর পর স্কুলে শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন বীরভূমের মিরিটির ব্রাহ্মণ সন্তান পল্টু। পরে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবেও কাজ করেছেন। ১৯৬৬ সালে বাংলা কংগ্রেসের মধ্য দিয়ে রাজনীতির আঙিনায় পা রাখেন প্রণব মুখোপাধ্যায়।

১৯৬৯ সালে বাংলা কংগ্রেসের টিকিটেই রাজ্যসভায় আসেন। ১৯৭১ সালে ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের বৈঠকে ভারতীয় প্রতিনিধি দলের সদস্য ছিলেন তিনি। প্যারিসের সেই বৈঠকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সওয়াল করেন প্রণব মুখোপাধ্যায়।

ধীরে ধীরে রাজনৈতিক জীবনে উত্থান ঘটে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের। ১৯৭৩ সালে বাংলা কংগ্রেস জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে মিশে যায়। ইন্দিরা গান্ধীর মন্ত্রীসভায় শিল্প মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী হন তিনি।

১৯৭৫ সালে রাজ্যসভায় জিতে সংসদে এলেও, ১৯৭৭ লোকসভা ভোটে মালদা থেকে জিতে পরাজিত হন। ১৯৮০ সালে বোলপুর থেকে ভোটে পরাজিত হলেও, বানিজ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন তিনি এবং তখন থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত টানা রাজ্যসভায় কংগ্রেসের নেতা ছিলেন।

১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত ইন্দিরা গান্ধীর মন্ত্রীসভায় অর্থমন্ত্রী ছিলেন তিনি। ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধী হত্যা এবং পরে রাজীব গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন। ইন্দিরা পুত্রের সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ায় রাজীব গান্ধীর মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পাননি তিনি।

সেই সময় কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস দল গঠন করেন। তবে কোনদিনই জননেতা ছিলেন না তিনি। ফলে নির্বাচনে ভরাডুবি হয় তাঁর দলের। ১৯৮৯ সালে কংগ্রেসে প্রত্যাবর্তন করেন।

http://sh103.global.temp.domains/~lyricsin/thequiry/the-lok-sabha-is-going-to-be-adjourned-due-to-corona-virus/

এরপর থেকে আর খুব একটা পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব সামলান। সেই সময় অর্থমন্ত্রী ছিলেন ডঃ মনমোহন সিং, যিনি ইউপিএ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হন।

পাঠকের সুবিধার জন্য এখন একটা কথা বলে রাখি সেই সময় অর্থমন্ত্রী হওয়ায় মনমোহন সিংহকে স্যার বলে সম্বোধন করতেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৬ পি ভি নরসিমা রাও জমানায় বিদেশ মন্ত্রীর দায়িত্ব সামলান।

২০০৪ সালে জঙ্গিপুর লোকসভা কেন্দ্রে ভোট জিতে মনমোহন সিং মন্ত্রিসভার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হন। পরে অর্থ, বিদেশ মন্ত্রকের দায়িত্ব সামলান। মাঝের ক’টা বছর বাদ দিলে জাতীয় রাজনীতিতে লুটিয়েন্সের দিল্লিতে বীরভূমের ব্রাহ্মণ সন্তানের ছিল দৃপ্ত পদচারণ।

ইন্দিরা গান্ধী মন্ত্রিসভায় নম্বর ২, নরসিমা রাও মন্ত্রিসভায় পরে যোগ দিয়ে নম্বর ২, মনমোহন সিং মন্ত্রিসভার নম্বর ২, একসঙ্গে পাঁচ জন গান্ধী নেতা ( ইন্দিরা, সঞ্জয়, রাজীব, সনিয়া, রাহুল) এর সঙ্গে কাজ করার পাঁচ দশকের বৈচিত্রময় রাজনৈতিক জীবনে অনেক উত্থান-পতনের সাক্ষী থেকেছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়।

তবে বরাবর নাম্বার টু হয়ে থাকার ক্ষোভটা মনের মধ্যে রেখে দিয়েছিলেন বীরভূমের বীর সন্তান। ২০১২ সালে প্রথমবার এক নম্বর হলেন, রাষ্ট্রপতি হয়ে তাঁর দীপ্ত পদচারণ রাইসিনা পাহাড়ে। বরাবরের কপিবুক আজীবন সংবিধান মেনে চলা প্রণব মুখোপাধ্যায়ের।

দেশের মধ্যেই শুধু নয়, আন্তর্জাতিক মহলও তাঁকে ভারতের ‘চানক্য’ বলেই জানত। প্রয়াত আরেক অর্থমন্ত্রী তথা বিজেপি নেতা অরুণ জেটলি একবার বলেছিলেন, “ভারতীয় রাজনীতির দুই স্তম্ভ, অটল বিহারী বাজপেয়ী এবং প্রণব মুখোপাধ্যায়”।

বিরাট পণ্ডিত এই ব্যক্তির সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা বা লেখার ধৃষ্টতা আমার নেই, শুধু এটুকু বলতে পারি, প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মত ব্যক্তির মৃত্যু হয় না।

তাঁর অবদান, দেশের রাজনীতি, কূটনীতি, পাঁচ দশকের রাজনৈতিক জীবনের উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। বীরভূমের পল্টু থেকে রাইসিনাহিলসের বাসিন্দা হওয়া প্রণব মুখোপাধ্যায়।

সম্পর্কিত পোস্ট