করোনা ও ইয়াসে বিপন্ন জনজীবন, কেন্দ্র-রাজ্য তরজায় জাঁতাকলে পিষছে আমজনতা
তানোজিৎ গাইন
করোনার প্রথম ওয়েভে বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর সাক্ষী থেকেছে গোটা দেশ। সেই রেসের মাঝেই ঘূর্ণিঝড় আমফানের তান্ডব। ঝড়ে আরও একবার লন্ডভন্ড সাধারণ মানুষের জনজীবন। তছনছ অর্থনৈতিক গতিপ্রকৃতি। ওলটপালট করে দিয়েছিল সমুদ্র উপকূলবর্তী জেলা পূর্ব মেদিনীপুর ও দুই ২৪ পরগণা জেলার ব্যাপক অংশের মানুষের রুটি রুজির সংস্থান।
এরপর বছরের শেষভাগে সাধারণ মানুষের জীবন কিছুটা হলেও ছন্দে ফিরতে শুরু করে। কৃষি উৎপাদন থেকে বৃহৎ কলকারখানা ও মাঝারি শিল্পের উৎপাদন দীর্ঘ কয়েক মাস বন্ধ থাকায় বহু শ্রমিককেই মৃত্যুর পথ বেছে নিতে হয়েছিল।টানা লকডাউনে আর্থিক কষ্ট অনেকেই সামলে উঠতে পারেননি। তবে সব খবর যে প্রকাশ্যে এসেছে তাও কিন্তু না।
তারপর আমরা এই ছবিও দেখেছি, রেল লাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে বহু পরিযায়ী শ্রমিক রেল লাইনের ধারেই শুয়ে পড়ে ক্লান্ত হয়ে। যার ফল মৃত্যু। সেই সময় দেশের সব রাজনৈতিক দলগুলি একে অপরকে দোষারোপ করতে ছাড়েনি। জনতার রোষানলে পড়ে দেশের প্রশাসনিক সিস্টেমও।
২০ পেরিয়ে ২১। বঙ্গ রাজনীতির কুর্সি দখলের লড়াই। কেন্দ্র বনাম রাজ্যের সংঘাতের তাপমাত্রার তীব্রতা ছিল যথেষ্ঠ। বর্তমান শাসক দলের অভিযোগ, অজস্র দিল্লির নেতা ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর কারণে এই রাজ্যে কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ বেড়েছে। তরজা চলল বেশ কিছুদিন। পরিণতি হলো নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর। ততদিনে করোনায় সংক্রমন-মৃত্যুর গ্রাফ গগনচুম্বী।
অন্যান্য রাজ্যের পাশাপাশি এরাজ্যেও জারি হল রাজ্যে লকডাউন। এবারও দেশজুড়ে মানুষের মৃত্যু মিছিল। চিতা জ্বলছে সারি দিয়ে। তার মাঝেই আতঙ্ক ছড়াল গঙ্গায় মৃতদেহ ভেসে আসা। অর্ধদগ্ধ অবস্থায় বিহারের বক্সার উত্তরপ্রদেশের গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়া হল দেহ। কারা এই অপরাধে যুক্ত? আদৌ সেই মৃতদেহ গুলি কোভিডের কিনা জানা নেই। তবে সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দারা অবশ্য সেরাজ্যের প্রশাসনের চূড়ান্ত ব্যর্থতাকেই দায়ী করেছেন।
যদিও অপরাধে যুক্ত কারা কিনারা হয়নি। দেশের প্রথম সারির সমস্ত সংবাদমাধ্যম পেয়ে গেলেন প্যানেল ডিসকাশনের নতুন টপিক। এতে লাভ কী হল? ভ্যাকসিন ও অক্সিজেনের হাহাকার কী মিটলো? অক্সিজেন সংকটে মৃত্যু মিছিল গোটা দেশ জুড়ে। সারাদেশে ছবিটা প্রায় একই রকম। করোনায় এখন অনেকটা রাস টানা সম্ভব হলেও টেস্ট কী পর্যাপ্ত হচ্ছে? প্রশ্ন থেকেই গেল।
এই মৃত্যু মিছিলের মাঝে আরও একটা প্রাকৃতিক বিপর্যয় ইয়াস। আমফানের থেকে তীব্র গতিতে সমুদ্র উপকূলবর্তী জেলা সহ দক্ষিণ এবং উত্তর ২৪ পরগনায় বিস্তীর্ণ অংশের মানুষের জনজীবন লন্ডভন্ড। নেই ছাদ। নেই অন্ন সংস্থানের উপায়।সরকার ত্রান পাঠালেও অনেকেই বঞ্চিত থেকে যাচ্ছেন।
সরকার রিভিউ বৈঠক করছেন ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সহায়তার জন্য। কিন্তু সেই সহায়তা পৌঁছতে জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ লেগে যাবে। ইয়াসের তাণ্ডবের দৃশ্য বাংলার অর্থনীতিকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। উপরন্তু ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের মত আরেকটি রোগের আবির্ভাব। বিরাট খরচ বহুল চিকিৎসা।
আদৌ স্বাস্থ্যসাথীতে চিকিৎসা হচ্ছে নাকি সেটা জানারও উপায় নেই। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মহামারীর বাজারে বেসরকারি হাসপাতালগুলো রোগীর পরিবারের কাছ থেকে লাখ লাখ অর্থ আদায় করে নিল। এর বিরুদ্ধে সরকার কী ব্যবস্থা নিলেন? বারবার সরকারের দ্বারস্থ হয়েছেন অনেক সাধারণ মানুষ। কিন্তু ফল মিলেছে কী? খোঁজ নিলে দেখা যাবে গ্রামের মানুষেরা কোভিড নিয়ে শহরে চিকিৎসা করাতে এসেছিলেন। অধিকাংশ মানুষ মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েছেন। আর বেসরকারি হাসপাতাল দেহ আটকে রেখে পয়সা আদায় করতে ছাড়েনি। এই অভিযোগ কোন ভাবে অস্বীকার করা যায় কি?
প্রশ্ন উঠবে মঙ্গল গ্রহে যান পাঠানো, অন্তরীক্ষে পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ১৩০ কোটির দেশ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান হওয়া সত্বেও, ভ্যাকসিন উতপাদনে দেরি কেন? তাহলে প্রশ্ন উঠবেই, স্বাধীনতার এতগুলো বছর পর কেন্দ্রীয় সরকার গণতান্ত্রিকভাবে ব্যর্থ। যেখানে মানুষের জীবন-মৃত্যুর সওয়াল, সরকার কেন ভাষণ বাজি করবে?
অভিযোগ ঘূর্ণিঝড় ক্ষতিগ্রস্থদের আর্থিক পরিমাণ প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। সবার সব চলে গেল। এই ক্ষতিপূরণের মানদণ্ড কে ঠিক করবে? নাকি আমফান দুর্নীতির রিপিট টেলিকাস্ট দেখবে বাংলার মানুষ? তারপর শুরু হয়ে যাবে বিরোধীদের সমালোচনা।
এই রাজ্যেরই বা আর্থিক পরিস্থিতি কি? কলকারখানায় উৎপাদন কম। তাছাড়া, নতুন শিল্প স্থাপনের উদ্যোগে অনীহা। তাহলে বেকার ছেলে মেয়েরা ধান ও আলু চাষ করে জীবন কাটাবে নাকি? এর উত্তর কার কাছ থেকে পাওয়া যাবে?
তৃতীয়বার ক্ষমতায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। করোনা ও ইয়াস মোকাবিলা সরকারকে করতে হচ্ছে। তারপর রোজগার, কর্মসংস্থান, কৃষি, শিল্পের কী হবে? এর উত্তর কি? আর্থিক সরলরেখা মজবুত করতে গেলে কেন্দ্রের সহায়তা ভীষণভাবে প্রয়োজন। রাজ্যের বক্তব্য, কেন্দ্রের বিমাতৃসুলভ আচারণে তারা একবারে পেরে উঠছে না। আর ক’টা মাস পর দুর্গাপূজা। গতবছর কুমোরটুলির মৃৎশিল্পী সহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের মৃৎশিল্পীরা কার্যত অনাহারে ছিল। এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। চলতি বছর কি হয়, সেটাই এখন দেখার। এখন বর্ষা আসেনি। অবিলন্বে সরকারকে বাঁধ নির্মানে সরকারকে নজর দিতে হবে। ইয়াসের তান্ডবের পর বর্ষায় ভারী বৃষ্টিতে কৃষিজমি প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সাধারন ও আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া মানুষগুলি সরকারের ওপর কি করে ভরসা করবে? কারণ কোভিড পরিস্থিতি যে হারে বাড়ছে তারপর রাজ্যে কলকারখানা যা আছে তা উৎপাদনমুখী করতে বেশ কয়েক মাস সময় লেগে যাবে। মানুষ খেতে পাক আর না পাক বিদ্যুতের বিল আর পৌরএলাকার কর এলাকার মানুষকে দিতেই হবে। এখানে সরকারের কোনো ছাড় থাকবে কি থাকবে? নির্মাণ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ঠিকা শ্রমিকের অধিকাংশই গরীব। তাদের পেট চলবে কি করে?
মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে ছেলেমেয়েরা উচ্চতর শিক্ষা অর্জন করে এই রাজ্যে কি কর্মসংস্থান পাবে? ক্ষুদ্র শিল্পে মেধাবী ছেলে মেয়েরা কি করবে ? তাদের ভিন রাজ্যে যেতে হবে না তো? এরকম প্রশ্ন বর্তমান সময় উঠবেই। প্রশ্ন ওঠা তো স্বাভাবিক।
বড় মল গুলির কথা না হয় ছেড়ে দিলাম। তাদের আর্থিক পুঁজি আছে। কিন্তু ছোট ছোট দোকান আছে যাদের, তারা কী করবে? কিন্তু হাওড়া ও দুই মেদিনীপুরের হোসিয়ারি শিল্পীরা কি করে জীবন কাটাবে? বাজার তো শেষ হয়ে গেল। পাশাপাশি বিড়ি শিল্পের সঙ্গে যুক্ত মুর্শিদাবাদ ও মালদার শ্রমিকদের করুণ অবস্থা।
এবার মালদা মুর্শিদাবাদ দুই জেলাতে আমের চাষ ভালো হয়েছে। বাগানে আম পড়ে আছে। খদ্দেরের দেখা নেই। সকাল ৭ টা থেকে ১০টা অব্দি মানুষ সবজি কিনবে, নাকি আম কিনবে? তাহলে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে আম চাষিরা এখন কি করবে? অনেকে তো দেনা করে আমবাগান নিয়েছিলেন। করোনার জন্য বিদেশে রপ্তানি করা যাচ্ছে না। একই অবস্থা পানচাষীদের। চলতি বছরে ইয়াস পান চাষিদের খাদের কিনারায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সরকার বিঘা পিছু কত টাকা দেবেন। তাতে কি ক্ষতি সামাল দেওয়া যাবে? এক-কথায় বেসামাল অবস্থা প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে।
কোন ক্ষুদ্র শিল্প এখন ভালো অবস্থায় তা মাইক্রোস্কোপ দিয়ে খুঁজতে হবে। নদীয়ার তাঁত শিল্পের কাঁচামাল পাচ্ছে না। যেটুকু রসদ আছে তাতেই কাপড় তৈরির অনেক সমস্যা। কারণ কলকাতার বড় বাজার বন্ধ। কাপড় বানাচ্ছে ঠিকই। তাতে একবেলার পেটও চলছে না। যা হচ্ছে হ্যান্ডমেড। পাওয়ার লুমে তো বিদ্যুৎ লাগবে।
আরও করুণ অবস্থা বাসে-ট্রেনে হকারী করে যারা দিন গুজরান করেন। কিছু স্পেশাল ট্রেন চলছে ঠিকই। তাতে হকারদের ওঠার অনুমোদন নেই।। গণ পরিবহন বন্ধ। অর্থাৎ কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে হকারদের জীবন দাঁড়িয়ে। এদের জন্য সরকারের কোনো ভাতা নেই। খিদের জ্বালায় মরছে প্রতিদিনই।
এই সামগ্রিক পরিস্থিতির জন্য সরকার দায়ী নাকি আমরা? নাকি কোভিড দায়ী? তা জানা নেই। এর উত্তর কে দেবে? সারাদেশে এখনও সরকার ভ্যাকসিনের পর্যাপ্ত যোগান দিতে পারেনি। এটাই বাস্তব। এই প্রশাসনিক ব্যর্থতা আর ভুল থেকে শিক্ষা না নেওয়ার ফসল হলো করোনা। তাই পুরো প্রতিবেদনে বাস্তব চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা। আত্মসমালোচনায় বলতেই পারি, এই পরিস্থিতিতে কেউ দায়ী না। দায়ী মানুষ। কারণ আমরা সচেতন হতে পারিনি।