কেটে গেল ২ বছর, দমেনি প্রতিশোধের স্পৃহা, পুলওয়ামার স্মৃতি এখনও টাটকা….
নয়ন রায়, নিউজ এডিটর, Thequiry
২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারী ভারতের ইতিহাসে কালো দিন। ঘটনার ২ বছর অতিক্রান্ত হলেও পুলওয়ামার স্মৃতি এখনো টাটকা। বীর শহীদ জওয়ানদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য। তাঁদের পরিবারের প্রতি আমার সমবেদনা।
সেদিনের পুলওয়ামা ঘটনা ঘটে যাওয়ার দিনই আমরা রওনা হয়েছিলাম জম্মু-কাশ্মীরের উদ্দেশ্যে। আমাদের গন্তব্য ছিল সুরানকোট। সুরানকোটের প্রাক্তন কংগ্রেস বিধায়ক চৌধুরী মহম্মদ আক্রমের সঙ্গে সাক্ষাৎকার সহ ভারত পাক সীমান্তের কাহিনী এবং দেশের সেবায় জওয়ানদের প্রতিনিয়ত যে কঠিন লড়াই তা জনগণের সামনে তুলে ধরাই আমাদের উদ্দেশ্য ছিল।
সারাদেশ যখন ভ্যালেন্টাইনস ডে পালন করছে তখনই ভয়াবহ জঙ্গি হানায় শহীদ হন ৪০ জন জওয়ান। দিল্লির প্রধানমন্ত্রী কেজরিওয়ালের ডাকা সভায় সেদিন দিল্লির যন্তরমন্তরে হাজির ছিলেন এরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। আমার সেদিনের সঙ্গী ছিল সহকর্মী শুভজিৎ চক্রবর্তী।
সন্ধ্যে সাড়ে ছটা নাগাদ লালকেল্লা থেকে বাস ছাড়লো। বাসে উঠে দেখলাম চোখে মুখে যাত্রীদের উৎকন্ঠা। কীভাবে তারা বাড়ি ফিরবেন। ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। ঘড়ির কাঁটায় রাত ১২ টা। বাস পৌঁছেছে কুরুক্ষেত্রে। হাড়কাঁপানো ঠান্ডায় বাস থেকে নেমে কোনোরকমে খাওয়া দাওয়া সারলাম। সকাল ৮ টায় বাস পৌঁছালো জম্মু শহরে। প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে বাস দাঁড়িয়ে গেল।
বাসের জানলা খুলে দেখছি চারদিক ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। একদিকে জম্মু-কাশ্মীর পুলিশ অন্যদিকে সিআরপিএফ। পুলিশ জানিয়ে দিল বাস আর যাবে না। গোটা শহর জ্বলছে। জম্মু হাইওয়েতে আমরা দাঁড়িয়ে। প্রায় ৪০ মিনিট পর দেবদূতের মত হাজির হলেন অটোওয়ালা পবনজি।
যদি সেদিন তিনি না থাকতেন হয়তো আমাদের জীবন বাঁচানোটাই চ্যালেঞ্জ হয়ে যেত। প্রায় দেড় ঘন্টা ধরে জম্মুর বিভিন্ন রাস্তা ধরে আমাদের হোটেল অবধি পৌঁছানোর চেষ্টা করলেও তিনি ব্যর্থ হলেন। অবশেষে আমাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নামিয়ে দিলেন হোটেল থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে।
চারিদিকে পুলিশ আর সিআরপিএফের কড়া নজরদারি। উন্মত্ত জনতা ইঁট ছুঁড়ছে। টায়ার জ্বালিয়ে প্রতিবাদ করছেন। তলোয়ার নিয়ে গোটা শহর ছুটে বেড়াচ্ছেন। ৪০ টি তরতাজা প্রাণ যাদের নৃশংসতায় অকালে ঝরে গেল তাদের প্রতি প্রতিশোধের স্পৃহা ক্রমশ ভয়ঙ্কর আকার নিতে শুরু করেছে।
আমাদের অটো থেকে নামিয়ে দিয়ে পবনজী ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন আমরা যেন সুস্থভাবে ফিরে আসতে পারি। তাঁর সেই প্রার্থনাটুকুই আমাদের সাহস যুগিয়েছিল। সেই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেই কোনোরকমে হোটেলে পৌঁছলাম। প্রত্যেক পদে পদে পুলিশ ও সিআরপিএফের বাধা। পরে তারাই আমাদের গাড়ি করে হোটেল অবধি পৌঁছে দেন।
চৌধুরী মহম্মদ আক্রম সাহেব হোটেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলার পর তবেই তারা আমাদের থাকতে দেন। তবে ততক্ষণে এটা বুঝেছিলাম যে উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা এসেছিলাম তা সম্ভব নয়। হোটেল থেকে বেরোনো কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না।
গোটা বিশ্বে সাড়া ফেলে দিয়েছিল সেদিনের ঘটনা।তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং ঘটনাস্থলে পৌঁছে সমস্ত পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেছিলেন। বিমানবন্দরে ভারত মাতার বীর সন্তানদের চোখের জলে বিদায় জানাতে উপস্থিত হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, রাহুল গান্ধী সহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরাও।
গোটা উপত্যাকা সেদিন ভারত মাতার বীর সন্তানদের স্মৃতিতে স্তদ্ধ। জম্মুর টাবি নদীর জলের স্রোতও যেন থমকে গিয়েছিল। পুলওয়ামার ঘটনার পর পাল্টা সার্জিকাল স্ট্রাইক হয়েছিল ভারতের তরফে।
তবে পুলওয়ামার ঘটনাও রাজনীতির আঙিনায় চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছিল। কারণ তার কিছুদিন পরই ছিল লোকসভা নির্বাচন। যদিও সেই বিতর্ক আজ প্রাসঙ্গিক নয়।
আমরা চাইনা পুলওয়ামার মত ঘটনা আবারও হোক। আমরা চাই সন্ত্রাসমুক্ত দেশ। আমরা চাই কোনো মায়ের যেন কোল খালি না হয়। এই দিনের কথা কোনোদিন স্মৃতিপট থেকে মোছা যাবে না।