“সীমার মাঝে, অসীম, তুমি বাজাও আপন সুর,আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ তাই এত মধুর….”

শুভজিৎ চক্রবর্তী

কোভিড-১৯ এর গ্রাসে গোটা বিশ্ব। মারনরোগের হাত থেকে বাঁচতে ঘরের ভিতরে আশ্রয় নিতে হচ্ছে মানুষকে। বিজ্ঞানের তরফে বলা হচ্ছে সামাজিক দুরত্ব রাখা ভীষণ জরুরি। কিন্তু এই সামাজিক দুরত্ব, আমাদের মানসিক দুরত্ব দিন দিন বাড়িয়ে দিচ্ছে।

মানুষের মধ্যে মতভেদের পার্থক্য এতটাই বেড়ে চলেছে যে করোনা থেকেও জাতপাতের কলুষতা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ঠিক এই সময়েই কবিগুরুর লেখা, গান, কবিতা এবং ভারতীয়দের ঐক্যবদ্ধ করে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর প্রতিটা কথা আজ প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে।

কবিগুরু তাঁর লেখা ‘চন্ডালিকা’ নৃত্যনাট্যে প্রকৃতি নামক এক অস্পৃশ্য মহিলার চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। যেখানে ওই মহিলা নিজেকে গোটা সমাজের থেকে দুরে সরিয়ে রাখতেন। হঠাত একদিন প্রকৃতির বাড়ির পথ দিয়ে যাওয়ার সময় এক তৃষ্ণার্ত সন্ন্যাসী তার কাছে জল চায়। কিন্তু নিজেকে ছোট জাত বলে পরিচয় দেয় ওই মহিলা। এমনকি সন্ন্যাসীকে জল না দিতে পেরে তাঁর থেকে ক্ষমা চেয়ে নেয় সে।

অনেক জোরাজুরিতে সন্ন্যাসী ভিক্ষুককে জল দিতে রাজি হয় সে। পরে ভিক্ষুক ওই মহিলাকে যা বললেন তাতে এটা দাঁড়ায়, আত্মঘাতীর থেকেও আত্ম-অপমান বড় পাপের৷ আজকের দিনে দাড়িয়ে কবিগুরুর কথাগুলো আরও নতুন করে আমাদের ঘুম ভাঙিয়ে দিচ্ছে।

আজও তো নীচু জাতের কোনও ব্যক্তি পাড়ার টিউবওয়েলে জল আনতে গেলে তাকে আড়চোখে এমনভাবে তাকানো হচ্ছে, যেন মারন ভাইরাসের বাসা ওই ব্যক্তির শরীরে প্রবেশ করেছে। আর উনি জল আনতে এসে তা ছড়িয়ে দেবেন।

১৯০৩ সাল দেশভাগ নিয়ে তরজা তুঙ্গে। তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড কার্জন বাংলাকে ভেঙে আলাদা করার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। সেই সময় মুসলিমদের নিয়ে আলাদা রাষ্ট্রের বিরোধিতা করতে রাস্তায় নেমে পড়েন তিনি। ভারতের অটুট ঐক্য বজায় রাখতে রাজপথে চলছে কবিগুরুর লেখা গান।

কিন্তু কোনকিছু সুরাহার জন্য হিংসার পথ নেওয়া একেবারে যে বেঠিক তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন তিনি। হিংসা নয়, বরং গঠনমূলক আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে ভারতের স্বাধীনতা লাভ করবেন এমনটাই আশা রেখেছিলেন তিনি।

“জীবন যখন শুকায়ে যায়
করুণা ধারায় এসো।
সকল মধুরী লুকায়ে যায়,
গীত সুধারলে এসো”।

১৯৪৬ সালে দেশভাগের প্রাক মুহুর্তে কলকাতায় এসে দীর্ঘদিন অনশন চালিয়ে গিয়েছিলেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। তখন কবিগুরুর লেখা গান যে তাকে ভুলিয়ে রেখেছিল। পরবর্তীকালে কবিগুরুর লেখা ” একলা চল রে” তার ভীষণ প্রিয় হয়ে ওঠে।

যদিও দুই মহান ব্যক্তিত্বের সখ্যতা ১৯১৫ এর শুরুর দিকে ভীষণভাবে বেড়ে উঠেছিল। গান্ধীজিকে মহাত্মা নামে সম্মোধন করতেন রবি ঠাকুর।

অন্যদিকে কবিগুরুকে গুরুদেব বলে ডাকতেন গান্ধীজি। পিছিয়ে পড়া অনগ্রসর ভারতবর্ষকে একজোট করার ক্ষেত্রে এই দুই মহামানবের অবদান অনস্বীকার্য।

আজ ১৫৮ বছর পরও বাঙালির সিলেবাসে রবিঠাকুরের বসবাস পাঠ্যবই এবং বাংলা ভাষাকে দিয়ে যাওয়া তার এই বিপুল সম্ভারকে নিয়ে। কিন্তু লেখনি ছাড়াও সমাজ গঠনের ক্ষেত্রেও তাঁর যে প্রত্যক্ষ ভুমিকা ছিল তা আমরা অনেকেই এড়িয়ে যাই।

কিন্তু আজ যখন মানুষের মধ্যে সামাজিক দুরত্ব সহ মানসিক দুরত্ব কাঁটাতারের মত দাগ টানতে শুরু করেছে, তখন সেই মহামানবকে স্মরণ করতে চলেছে গোটা বিশ্ব।

শুধুমাত্র দুটো দেশের জাতীয় সঙ্গীত নয়, মানুষের মধ্যে মানবতাবোধ উন্মোচনের দিশা দেখিয়েছেন কবিগুরু। তাঁর জন্মদিনে দ্য কোয়ারি তাঁকে জানায় লহ প্রণাম।

বিপর্যয়ের হাত থেকে উদ্ধার করতে সহনশীলের রাস্তা নিক গোটা বিশ্ব। আর তাঁর গানই হয়ে উঠুক মনুষ্য জাতীর কাছে নতুন করে প্রেরণা। আপনার সৃষ্টিতে নতুন করে বাঁচুন আপনি। বেচে উঠুক গোটা বিশ্ব।

সম্পর্কিত পোস্ট