আজও সমান প্রাসঙ্গিক কবিগুরু,বন্দি আমাদের চেতনায় মনে, চিন্তায়, প্রতি পদেপদে
বাংলা সাহিত্য, তৎকালীন সমাজ থেকে শুরু করে বিশ্ব ইতিহাসের পাতায় নিজের জায়গা করে নিয়েছিলেন সাহিত্যচর্চার জোরে। তিনি একাধারে ছিলেন ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক
রাহুল গুপ্ত
তিনি বোধহয় বুঝতে পেরেছিলেন, আজ থেকে ১৫৯ বছর পরেও বাঙালি তথা গোটা ভারতবাসীর কাছে ‘চিরনতুন’ থাকবে তাঁর জন্মদিন। বোধহয় তাই নিজের জন্মদিন নিয়ে লিখে গিয়েছিলেন গান, কবিতা। আজ ২৫ বৈশাখ। ১৫৯ বছর আগে ঠিক আজকের দিনেই কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
কবিগুরু আজ শৃঙ্খলমুক্ত। রবীন্দ্র গ্রন্থ সত্ত্বের নিষেধাজ্ঞার ইতি। সত্যি এখন সৃষ্টির রবীন্দ্রনাথ মুক্ত। এ মুক্তি ভালো কি মন্দ সেই তর্কে না গিয়ে বরং বলা ভালো এক শ্রেণীর জনগণ নিশ্চই খুশি। আজকের দিনে রবীন্দ্রসংগীতকে রকে পরিণত করতে দ্বিধা করেননি কিছু শিল্পী।
বাংলা সাহিত্য, তৎকালীন সমাজ থেকে শুরু করে বিশ্ব ইতিহাসের পাতায় নিজের জায়গা করে নিয়েছিলেন সাহিত্যচর্চার জোরে। তিনি একাধারে ছিলেন ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক।
১৮৬১ সালের ৭ই মে (২৫ বৈশাখ, ১২৬৮) জন্মগ্রহণ করেন ব্রাহ্ম ধর্মগুরু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সারদা দেবীর সন্তান রবীন্দ্রনাথ।জন্ম থেকেই নিয়মিত বিদ্যালয়ে যাওয়া ও প্রথাগত শিক্ষার ওপর অনিহা ছিল তাঁর।
বাড়িতেই তাই গৃহশিক্ষকের কাছে পড়াশোনা শিখেছিলেন তিনি। বেড়ে ওঠায় ছিল না কোনও প্রাচুর্য্যের ছোঁয়া। পরবর্তীকালে ইংল্যান্ডে আইন নিয়ে পড়াশোনা করতে গেলেও শেষ করতে পারেননি পড়াশোনা। রবির মন বরাবরই ছিল সাহিত্য অনুরাগী। তাই বিদেশ যাওয়ায় ইংরেজি সাহিত্যের সংস্পর্শে থাকার দরজা খুলে গিয়েছিল তাঁর কাছে।
“সীমার মাঝে, অসীম, তুমি বাজাও আপন সুর,আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ তাই এত মধুর….”
১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলী কাব্যগ্রন্থ অনুবাদ করার জন্য তিনি নোবেল পুরষ্কারে সন্মানিত হন। নিজের উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন তৎকালীন সামাজিক সংশোধনেও।
জেনে নিন প্রবাদপ্রতিম এই চরিত্রের জীবনের অজানা কিছু ঘটনা।
- জন্মদিন নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলতেন, ‘ধরতে গেলে প্রতিদিনই তো মানুষের জীবনে নববর্ষ আসে। মানুষ নবজন্ম লাভ করে। প্রতিদিনই নতুন করে তার পর্ব শুরু হয়। তাকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফেলে রাখা ঠিক নয়।’
- সকালে দেরি করে ওঠায় প্রবল আপত্তি ছিল রবীন্দ্রনাথের। তাঁর কথায়, ‘এমনি করে দিনের অনেকখানি সময় আলস্য খাবলে নেয়। এ কখনোই হতে দেওয়া যায় না।’
- ১৯১৩ সালের ঘটনা। পাঠভবনের শিশুদের আম্রকুঞ্জে গাছের তলায় ইংরাজি পড়াচ্ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেইসময় ক্ষিতিমোহন সেন এসে জানান,বিদেশ থেকে খবর এসেছে। নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। খবর শুনে প্রথমেই তিনি বলেন, বিশ্বভারতীর ড্রেন কাটার সংস্থান হবে ওই টাকা থেকে। বিশ্বভারতীর আর্থিক দায়িত্ব ছিল প্রায় সমস্তটাই রবীন্দ্রনাথের।
- একবার রবীন্দ্রনাথের সচিব অনিল চন্দ ও তাঁর স্ত্রী রাণি চন্দের ছয় মাসের ছেলের কান্না শুনে মধ্যরাতে নিজের বায়োকেমিকের বাক্স থেকে বেছে ওষুধ নিয়ে তাঁর বাড়িতে ছুটে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। শিশুটির নাম ছিল অভিজিৎ। রবীন্দ্রনাথ তার নাম তিনি দিয়েছিলেন যুবরাজ। ভীষণ স্নেহ করতেন শিশুটিকে।
- রবীন্দ্রনাথ বলতেন তিনি নাকি রংকানা। লাল রং নাকি তাঁর চোখে ধরা পড়ে না। অথচ নীল রঙ তিনি ভীষণ ভালো করে খুঁজে পেতেন। ছবি আঁকতে ভালোবাসতেন তিনি। প্রথমে পেন্সিল দিয়ে ঘষে রং তৈরি করে তার ওপর আবার রং করতেন। বলতেন তাতে রং জোরালো হয়।
- রবীন্দ্রনাথের সব সময়ের সঙ্গী ছিলেন এক পরিচারক, তাঁর নাম বনমালী। বনমালীর বিশ্বাস ছিল, মুম্বই শহরে গেলে নাকি তাঁর গায়ের কালো রং ফর্সা হয়ে যাবে। রবীন্দ্রনাথ তাই একাধিকবার বনমালীকে তাঁর সঙ্গে গিয়ে মুম্বইতে থাকার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
- এই বনমালীকে একবার নিজের হাতে সাজিয়ে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রাজমাতা ললিতা দেবীর আমন্ত্রণে হায়দরাবাদের ভিজেনা গ্রামে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই সফরেও সঙ্গী ছিলেন বনমালী। রাজবাড়িতে যেতে হবে বলে নিজের সিল্কের পাজামা ও কালো ভেলভেটের টুপিতে বনমালীকে সাজিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।
- নারীদের স্বনির্ভরতার ওপর জোর দিতের রবীন্দ্রনাথ। বলতেন, মেয়েরা জন্মায় মায়ের পরিপূর্ণতা নিয়ে,দেখা গেছে যেখানে মা পরিপূর্ণ সেখানেই নারীর জন্ম হয়েছে। সংসারে যে কোনও জায়গায় আয় করা মেয়েদের খুব প্রয়োজন। যে কোনও হাতের কাজ যেন কেবলমাত্র শৌখিন ঘর সাজানোর জিনিস না হয়। তাকে ব্যবসার কাজে লাগিয়ে যাতে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারে মেয়েরা সেই ব্যবস্থা করতে হবে। ঠিক যেমন সাঁতার জানা থাকলে জলে আর ভয়ে থাকে না , তেমনই উপার্জনের রাস্তা জানা উচিত মেয়েদের।
- একবার ট্রেন থেকে নেমে গাড়ি করে রাজবাড়ি যাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ। হঠাৎ শোনা গেল তিনি বিড়বিড় করে কী যেন বলছেন আর হাসছেন। কাছে যেতে শোনা গেল,তিনি বলছেন, ‘সেনগুপ্ত, দাশগুপ্ত, সেনগুপ্ত, দাশগুপ্ত’। অর্থ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, শুনতে পাচ্ছিস না, গাড়ির চাকায় শব্দ উঠেছে, ‘সেনগুপ্ত, দাশগুপ্ত।’
- পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীর পালিতা কন্যা নন্দিনীর বিয়ের আসর বসেছিল শান্তিনিকেতনের উদয়নের চাতালে। রবীন্দ্রনাথ নিজে বিয়ের সমস্ত আয়োজন করেছিলেন।
- কিশোর থেকে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত জীবনে অনেক মৃত্যু দেখেছেন রবীন্দ্রনাথ। একবার রাণী চন্দকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘মৃত্যুকে আমি ভয় পাইনে। যারাই মৃত্যুর দ্বার পর্যন্ত গিয়ে ফিরে তাঁরাই বলেছেন,মৃত্যু কেবলমাত্র ৫ মিনিটের কষ্ট, তারপরেই শান্তি। এই ৫ মিনিটের কষ্ট সহ্য করতে পারব না! ভয় পাই মৃত্যুটা যখন লিঙ্গার করে তখনই। ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথ ১১ বছর বয়সে মুঙ্গেরে বেড়াতে গিয়ে মারা যান। তাঁকে দাহ করে ফেরার সময় আকাশে জোৎস্নার সৌন্দর্য্য মুগ্ধ করেছিল তাঁকে। সেই উল্লেখ পাওয়া যায় তাঁর লেখাতেও।
- বিশ্বভারতীর রবীন্দ্র গ্রন্থ সত্বের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া নিঃসন্দেহে ক্রেতা , পাঠক , পুস্তক বিক্রেতা , প্রকাশক সবার কাছে খুব আনন্দের সংবাদ। কিন্তু সেক্ষেত্রে রবীন্দ্রসাহিত্যকে ডোন্ট কেয়ার মনোভাব দেখিয়ে ব্যবসা ঠিক নয়।
- আজ রবীন্দ্রনাথ মুক্ত পুরুষ। করোনা ভাইরাসে তিনি পৃথিবীতে বন্দি আছেন আমাদের চেতনায় , মনে , চিন্তায় , প্রতি পদেপদে। তাই তো আজও আমরা কবিগুরুতেই বাঁচি ও মরি।
ভালোবাসার শ্রদ্ধায় তিনি আছেন , থাকবেন আজ , কাল – সারাজীবন।