শুভেন্দু আধিপত্যে অন্তরালে রাজীব, ক্ষোভে ফুঁসছে বিজেপি
সহেলী চক্রবর্তী
তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যখন মুকুল রায় যোগ দিয়েছিলেন তখন সেই ঘটনাকে তৃণমূলের ইন্দ্রপতন বলে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল। এবার সেই মুকুল রায় তাঁর পুরনো ঘরে ফিরলেন। তাহলে এই ঘটনাকে কি ব্যাখ্যা করা হবে?
দল ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে মুকুল রায়কে। তার জন্য একমাত্র দায়ী শুভেন্দু অধিকারী। যদিও কোন সংবাদমাধ্যমে একথা সরাসরি না দেখানো হলেও এমনটাই ইঙ্গিত করেছেন ভারতীয় জনতা পার্টির অনেক নেতৃত্বই।
একই সঙ্গে দায়ী করা হচ্ছে অমিত শাহ এবং জেপি নাড্ডা জুটিকে। অনুপম হাজরা নিজের ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন অনেকের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তাদেরকে বসিয়ে রাখা হয়েছিল। অপমান আর অবজ্ঞার ফল ভারতীয় জনতা পার্টি হাতেনাতে পেয়ে গেছে। তাই যারা সমালোচনা করছে তাদের বেসুরো বলে অসম্মান না করাই উচিত।
এ প্রসঙ্গেই দলের অন্দরে উঠে এসেছে রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম। তৃণমূলে থাকাকালীন কোনো দুর্নীতির সঙ্গে বা কোনো বিতর্কিতমূলক মন্তব্যের সঙ্গে জড়ায়নি তাঁর নাম। সংবাদমাধ্যম থেকে আড়ালেই থাকতেন তিনি। নীরবে থেকে একের পর এক জনকল্যাণমূলক কাজ করে গিয়েছেন।
বিধানসভা নির্বাচনের আগে সেই রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় অমিত শাহের হাত ধরে যোগদান করেন বিজেপিতে। অমিত শাহ নিজে আসতে না পারায় চার্টার্ড বিমানে দিল্লি উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয় রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়কে। রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাহী যোগদান হলেও কোনরকম সাংগঠনিক কাজে তাঁর কোনও মন্তব্যকে গ্রাহ্য করা হয়নি।
” আমি শুভেন্দু, জানি কোথায় কী করতে হবে”
বিজেপি নেতৃত্বদের একাংশের অভিযোগ প্রথম থেকেই শুভেন্দু অধিকারী চেয়েছিলেন বঙ্গ বিজেপিতে নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে। বরাবরই ক্ষমতার বৃত্তে থাকতে পছন্দ করে এই অধিকারী পরিবার। ব্যাতিক্রম হয়নি ভারতীয় জনতা পার্টিতে এসেও।
গেরুয়া শিবিরের অন্দরমহল সূত্রের খবর, শুভেন্দু অধিকারীর ইমেজ বাংলার মানুষের কাছে স্বচ্ছ নয়। নন্দীগ্রামের আরএসএসের বৃহৎ অংশ বিজেপি প্রার্থী শুভেন্দুকে নিয়ে মোটেই খুশি ছিলেন না। সবসময় স্বচ্ছ ভাবমূর্তি ও আপাদমস্তক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে চেয়েছিলেন তারা।
শৃঙ্খলাপরায়ন, স্বল্পভাষী ও সৎব্যক্তি হিসাবে রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের গুরুত্ব সবথেকে বেশি হওয়া উচিত ছিল বলে মনে করছেন বঙ্গবিজেপির অনেকে। বিভিন্ন জায়গায় প্রচারে গুরুত্ব পেয়েছেন শুভেন্দু। সে জায়গায় শুভেন্দুর পরিবর্তে রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়কে মুখ করা হলে মাইলেজ পেত ভারতীয় জনতা পার্টি।
যুব সম্প্রদায়কে রাজনীতিমুখী করার ক্যরিশমা রাজীব বেশ ভালো জানেন। তৃণমূলে থাকাকালীন ২০১৯ উপনির্বাচনে টাফ ফাইটে দলকে জিতিয়ে নিয়ে এসেছিলেন রাজীব। যুব সংগঠনের সঙ্গে মাদার সংগঠনের সমন্বয় কিভাবে করতে হয় এই বিষয়ে তাঁকে টেক্কা দেওয়া মুশকিল। সেখানেই বিজেপির অন্দরে সমন্বয়ের অভাবের কথা বারবার বলা হলেও তা পাত্তা দেয়নি গেরুয়া শিবির।
শুধু তাই নয়, একের পর এক উস্কানিমূলক মন্তব্য এবং কুরুচিকর ভাষায় তৃণমূল সু্প্রিমোকে আক্রমণ বিজেপিকে বারবার পেছনে ফেলে দিয়েছে। যদি রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে ব্যাটন থাকতো বিধানসভা নির্বাচনে ভরাডুবি বিজেপিকে দেখতে হতো না।
শুভেন্দু অধিকারীর বাড়বাড়ন্ত ও প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে তার একক সিদ্ধান্ত বিপাকে ফেলেছে গেরুয়া শিবিরকে। ফল প্রকাশের পর শুভেন্দুর ঔদ্ধত্য এতটাই চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে এক ঘরে করে দেওয়া হয় মুকুল রায়কে।
আগেই বিজেপির এক বর্ষীয়ান নেতা অভিযোগ করে জানিয়েছিলেন, শুভেন্দু অধিকারীর জোর করে প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অ্যাপোয়েন্টমেন্ট নিয়ে দেখা করতে গিয়েছেন দিল্লিতে। সেইসঙ্গে রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষকেও ডোন্ট কেয়ার অ্যাটিটিউড দেখান তিনি। শুভেন্দুর লক্ষ্য বঙ্গবিজেপিতে রাজত্ব করা। অধিকারী সাম্রাজ্যের শ্রীবৃদ্ধি করা।
বিধানসভা নির্বাচনে দল ডুবিয়েছেন শুভেন্দু ! চমকাচ্ছেন দিলীপ ঘোষকে! বিস্ফোরন বঙ্গ বিজেপিতে
তৃণমূলের প্রথম সারির নেতা ফিরহাদ হাকিম ইতিমধ্যেই জানিয়েছেন রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ছোট ভাইয়ের মতো। যদি সে ভুল করেও থাকে সে নিজেই বুঝেছে। সে ফিরতে চাইলে সিদ্ধান্ত নেবে দল।
অন্যদিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়ে দিয়েছেন যারা চরমপন্থী অর্থাৎ তীক্ষ্ণ ভাবে বিরোধিতা করেছেন তৃণমূল কংগ্রেসের তাদের দলে ফিরিয়ে নেওয়া হবে না। যারা দল বিরোধী মন্তব্য করেনি একমাত্র তাদেরকে ফিরিয়ে নেওয়া হবে।
রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় বরাবরই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছেন। দল ছাড়লেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি তাঁর সঙ্গে ছিল প্রতিমুহূর্তে। রাজনীতিতে গুরুর প্রতি শিষ্যের এমন বিরল সৌজন্য-শ্রদ্ধার নজির নেই বললেই চলে। এককথায় রাজীব যুব সমাজের আইকন।
রাজনৈতিক মহলের মতে খুব শীঘ্রই তৃণমূলের অনেকেই চাইছেন ফিরে আসুক রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়। বঙ্গ রাজনীতিতে তার মত রাজনীতিবিদ খুব কম রয়েছে। বর্তমানে সৌজন্যে হারাচ্ছে রাজনীতি।
ইতিমধ্যেই দিলীপ ঘোষ, সায়ন্তন বসু, রাহুল সিনহার মন্তব্যর ফল ভুগছে বিজেপি।এখানেই ব্যতিক্রম রাজীব।তৃণমূলে থাকাকালীন বা বিজেপিতে যোগ দিয়ে কোনোদিন কুরুচিকর ভাষায় আক্রমণ বা ব্যক্তি আক্রমণ তিনি করেননি।
ঠিক যেভাবে মুকুল রায়কে দল ছাড়তে বাধ্য করেছে শুভেন্দু, ঠিক একই কায়দায় রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়কেও বিজেপি ছাড়তে বাধ্য করা হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন গেরুয়া শিবিরের অনেকেই।
তাদের মতে, একচ্ছত্র অধিকার প্রতিষ্ঠা করাই শুভেন্দুর একমাত্র লক্ষ্য। বাংলার মানুষের উন্নয়ন করার কোন মানসিকতা তার মধ্যে নেই। তাই যদি থাকতো, তাহলে রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত থেকে যখন সেচ দপ্তরের দায়িত্ব শুভেন্দুকে দেওয়া হয়েছিল, তারপর কেন কোনো কাজ করলেন না তিনি? ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের একের পর এক বাঁধ ভাঙায় এই প্রশ্ন উঠছে শাসক-বিরোধী দুই শিবিরেই।
গেরুয়া শিবিরের কর্মী সমর্থকরা বলছেন, প্রকাশ্যে টাকা নেওয়া থেকে শুরু করে পরিবহন ও সেচ দপ্তরে দুর্নীতিতে ঘুঘুর বাসা বানিয়ে ছিলেন শুভেন্দু। সেসব থেকে পিঠ বাঁচাতে এখন আশ্রয় নিয়েছেন গেরুয়া শিবিরে।
বরাবরই স্বচ্ছ ভাবমূর্তির রাজনীতিবিদদের কাঁধে ভর করে ক্ষমতার বৃত্তে থেকেছেন শুভেন্দু। ভারতীয় জনতা পার্টিতে যোগ দেওয়ার পরেও বেশিরভাগ সময় রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাঁধে ভর করে ইমেজ তৈরী করতে দেখা গিয়েছে শুভেন্দুকে।
রাজনীতিবিদদের মতে, মুকুল রায়ের মতো রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় যদি শিবির বদল করেন তাহলে বিরাট ক্ষতি হবে ভারতীয় জনতা পার্টির। আগামী দিনে ভারতীয় জনতা পার্টির নাম ও নিশান যদি পশ্চিমবঙ্গের মাটি থেকে মুছে যায় তার একমাত্র কারণ হবেন শুভেন্দু অধিকারী।