পচা গন্ধ ছড়িয়ে…ওখানেই কিছু আছে

ভ্যাপসা পচা গন্ধ ছড়িয়ে আছে। বুক কেঁপে গেল সবার। তাহলে এখানেই কি ….! ইয়াসিন সেই গন্ধটা আরও তীব্র অনুভব করল।

এ গন্ধ যারা চেনে তারাই জানে আসে পাশে কোথাও লাশ পড়ে রয়েছে। মাছি ভনভন গলে যাওয়া দেহ থেকে ছড়িয়েছে সেই ভ্যাপসানি গন্ধ। এ গন্ধে মানুষের গা গুলিয়ে যায়। আর বাঘ জানে আজ মহাভোজ।

ভয়ঙ্কর এক অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন সুন্দরবনের কিংবদন্তি নেতা, প্রাক্তন মন্ত্রী কান্তি গাঙ্গুলী। যে কোনও সামুদ্রিক ঝড় মোকাবিলায় বর্ষীয়ান সিপিআইএম নেতার অভিজ্ঞতা প্রশিক্ষণ নেওয়া দুর্যোগ মোকাবিলা কর্মীদের কাছে বিস্ময়। ঠিক তেমনই অবাক করা জীবন কান্তিবাবুর।

এ ঘটনা ২০১৯ সালের। বুলবুল সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়েছিল বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় জেলা দক্ষিণ ২৪ পরগনায়। ঝড়ের পর যথারীতি উদ্ধারকাজে নেমেছিলেন কান্তিবাবু।

দাদা আপনাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে না।আপনার বয়স হয়েছে, সমুদ্রের বুকে বেশ কয়েকদিন থাকতে হবে। আপনার শরীরে সইবে না।

-আরে ধুর, তোদের সঙ্গে থাকলে কিছু হবে না।

ঝড় থামার পর লন্ডভণ্ড এলাকায় যাওয়ার আগে উদ্ধারকারী দলের নেতা ইয়াসিন গাজীর সঙ্গে কান্তিবাবুর এমনই কথা চলছে। অভিজ্ঞতার দুরন্ত বর্ণনা দিয়ে তিনি লিখেছেন, দশজন মৎস্যজীবী নিখোঁজ। তাদের মা বৌ সন্তানদের বুকফাটা কান্না মণি নদীর তট থেকে বাড়ির উঠোনে শোনা যাচ্ছিল। “ইয়াসিনের দলবলের সঙ্গে আমিও রওনা দিলাম ছাইমারি দ্বীপের উদ্দেশ্যে।”

বুলবুল ঘণ্টায় ১৬০ কিলোমিটার গতিবেগ নিয়ে আছড়ে পড়েছিল। ঝড়ের মুখে পড়ে সুন্দরবনের ছাইমারি দ্বীপের কাছে ডুবে যায় সাগরকন্যা-১ ট্রলার। কয়েকজন কোনরকমে সাঁতরে দ্বীপে ওঠে। বাকিরা ডুবে যায়। সলিল সমাধি।

কেউ কি আর বেঁচে আছে? ছাইমারি দ্বীপে নেমে এমনই মনে হয় সবার। উত্তাল সাগরের এই দ্বীপ ভয়ঙ্কর। খোঁজাখুঁজি শুরু হলো। তিনটি দেহ উদ্ধার করার পরেও চিন্তা বাকিরা কোথায়? দ্বীপের জঙ্গলে ঢুকলেন কান্তি গাঙ্গুলী, ইয়াসিন ও বাকিরা। ঝড়ের পর তিনদিন তিনরাত কেটেছে। আশা কম। তবু মিরাক্যাল! গাছের উপরে বসে থাকা আরও তিনজনকে পাওয়া গেল। বিরাট ব্যাপার।

কিন্তু হাওয়ার সঙ্গে আসছে ভ্যাপসা পচা গন্ধ। কান্তিবাবুর অভিজ্ঞতা বলছে বিপদ সামনেই। ইয়াসিন সেই গন্ধ পেয়ে জঙ্গলের ভিতর ঢোকে। কিছুদূর যেতেই পচা গন্ধ আরও তীব্র হয়। গা গুলিয়ে আসছে। ইয়াসিন থমকে গেল। আর এগোনো যাবে না। একটু দূরেই পড়ে থাকা দেহের উপর কামড়ে চলেছে সুন্দরবনের রাজা। পচা গলা দেহের উপর মাছি ভনভন করছে। ফিরে আসে ইয়াসিন। বাঘের মুখে তখন তার ছোটবেলার বন্ধু হীরেনের দেহ।

কান্তিবাবু লিখেছেন, ওরা বাঘটাকে তাড়ানোর চেষ্টা করেছিল। আসলে বাঘ এই রকম একটা খাবার পেলে বেশ কয়েকদিন ধরেই খায়। শেষ পর্যন্ত ইয়াসিন আমার সতর্কবার্তা মনে করে প্রিয় বন্ধুর দেহ ফেলে রেখে বিষন্ন অবস্থায় ট্রলারে উঠল। আমি ইয়াসিনের মতো সাহসী কে দেখে অবাক হয়ে গেলাম। বাঘের মুখোমুখি হতে অকুতোভয়, কিন্তু বাল্যবন্ধুর মা, স্ত্রীর সামনে যেতে হবে ভেবে চোখের জল ফেলছে।

জীবন এমনই। বাদা বন-ভাটি অঞ্চলের মানুষ এমন জীবন পছন্দ করে।

(কান্তি গাঙ্গুলীর লেখা বই “রক্তপলাশের আকাঙ্খায়” থেকে সংগৃহীত মূল ঘটনা)

সম্পর্কিত পোস্ট