বিধানসভা নির্বাচনে দল ডুবিয়েছেন শুভেন্দু ! চমকাচ্ছেন দিলীপ ঘোষকে! বিস্ফোরন বঙ্গ বিজেপিতে
সহেলী চক্রবর্তী
বঙ্গ বিজেপিতে এখন ফার্স্ট পেজে রয়েছেন শুভেন্দু অধিকারী। নন্দীগ্রামে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে যৎসামান্য ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন তিনি। যদিও তার এই জয় নিয়ে রয়েছে বিস্তর জল্পনা।
সে সব এখন অতীত শুভেন্দু এখন নন্দীগ্রামের বিধায়ক। শুধু তাই নয় বিধানসভার বিরোধী দলনেতাও। অর্থাৎ বলা যেতে পারে বিধানসভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখোমুখি সম্মুখসমরে একদা তারই শিষ্য শুভেন্দু অধিকারী।
একথা শাসকদল মেনে নিলেও মানতে পারছেন না বঙ্গ বিজেপির অধিকাংশ নেতাই। শুনতে অবাক লাগলেও এটাই বাস্তব।
ইসবার দো’সো পার স্লোগান উঠলেও বঙ্গ বিজয় রথের চাকা থেমে গিয়েছে 77এ। তার মধ্যে দুজন ইস্তফা দিয়েছেন বিধায়ক পদ থেকে। তারা সাংসদ হিসাবেই থাকতে চান। এই মুহূর্তে সংখ্যাটা 75।
বিজেপির অন্দরমহল সূত্রে যে খবর উঠে আসছে তাতে যে কোন মুহূর্তে এই সংখ্যা যদি উল্টে যায় বা উল্টে গিয়েও আরও যদি কমে যায় তাহলেও অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। কিন্তু কেন বঙ্গ বিজেপির এরকম পরিস্থিতি?
চুলচেরা বিশ্লেষণে উঠে এসেছে বিস্ফোরক তথ্য। তৃণমূল থেকে বিজেপিতে এসে শুভেন্দু একচ্ছত্র সাম্রাজ্যের অধিকারী হতে চাইছেন। তাতেই বেজায় চটেছেন বঙ্গ বিজেপির প্রথম সারির আদি নেতারা। বিজেপির অন্দরমহলের এক নেতার কথায় দিলীপ ঘোষকেও নাকি আজকাল ধমকাচ্ছেন শুভেন্দু!
ভোট মিটতেও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে নারদা মামলা। তৎপর হয়ে উঠেছেন সিবিআই আধিকারিকরা। সরাসরি ভোররাতে বিছানা থেকে কার্যত তুলে নিয়ে গ্রেফতার করা হল ফিরহাদ হাকিম, মদন মিত্র, সুব্রত মুখোপাধ্যায় এবং শোভন চট্টোপাধ্যায়কে। আর সেখানেই বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছেন শুভেন্দু অধিকারী।
শুধু তাই নয় কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের জরুরি তলব এ সোজা কাউকে কিছু না জানিয়ে পাড়ি দিচ্ছেন দিল্লিতে। পশ্চিমবঙ্গের আইন-শৃঙ্খলা তলানিতে ঠেকে গিয়েছে বলেন নালিশ ঠুকছেন শাহী দরবারে। দাবি করছেন রাষ্ট্রপতি শাসনের। ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলছেন রাষ্ট্রপতি শাসনের থেকেও খারাপ অবস্থা রয়েছে পশ্চিমবঙ্গে।
যদিও শুভেন্দু অধিকারীর এই মন্তব্যের সঙ্গে বঙ্গ বিজেপি-র অনেক নেতাই সহমত নন। তা সংবাদমাধ্যমে না প্রকাশ হলেও মুরলীধর সেন লেন এবং হেস্টিংসের পার্টি অফিসে কান পাতলেই শোনা যাবে। কটাক্ষের সুরে এক আদি বিজেপি কর্মী বলছেন, পিঠ বাঁচাতে দিল্লি ছুটেছেন শুভেন্দু। এক প্রকার জোর করেই মোদী- শাহের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েছেন শুভেন্দু। বাকি সব বাহানা।
এই মুহূর্তে বঙ্গ বিজেপির যা পরিস্থিতি তাতে এক কথায় বলা যেতে পারেন বোল্ড আউট হয়ে গিয়েছেন মুকুল রায় । সৌজন্যে শুভেন্দু অধিকারী।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বর্ষীয়ান এক বিজেপি নেতার কথায়, সেচ দপ্তর ও পরিবহনে থাকাকালীন প্রচুর দুর্নীতি করেছেন শুভেন্দু অধিকারী। মমতার সরকার যদি তদন্ত করে তাহলে শুভেন্দু অধিকারী ফেঁসে যাবেন। শুধু তাই নয় নারদা মামলা থেকে বাঁচতে ও একের পর এক সীমাহীন দুর্নীতি থেকে নিজের পরিবারসহ নিজেকে আড়াল করতেই বিজেপিতে আশ্রয় নিয়েছেন।
এখানেই ক্ষান্ত হননি সেই বর্ষীয়ান নেতা। বললেন, বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির এই বিপুল পরাজয়ের অন্যতম মূল কারণ শুভেন্দু অধিকারী। একের পর এক নেতাদের যেভাবে শুভেন্দু বিজেপিতে এনে ভিড়িয়ে দিয়েছিলেন তাতে আপত্তি ছিল অনেকেরই। কিন্তু শীর্ষ নেতৃত্বের কেউই সেসময় কর্ণপাত করেনি। আর এখন যা পরিস্থিতি তাতে বঙ্গ বিজেপিতে শুভেন্দু রাজ চলছে। আর কয়েকদিন পর হয়তো দিলীপ ঘোষও মুকুল রায়ের মতো সাইড হয়ে যাবে।
বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। তা সত্ত্বেও একের পর এক ইস্যুতে বিরোধিতা যেন থামছেই না। কখনো দাবি উঠছে রাষ্ট্রপতি শাসনের। তো কখনো কেন্দ্র থেকে সরাসরি আক্রমণ শানানো হচ্ছে মমতা সরকারের ওপর। যা ভালো ভাবে নেবেন না বা নিচ্ছেন না এ রাজ্যের মানুষ। সেটা বুঝছেন বিজেপির অনেক নেতাই। কিন্তু বুঝেও কিছু করার থাকছে না।
রাজনৈতিক মহলের মতে বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির পরাজয়ের অন্যতম কারণ তাদের প্রতিহিংসাপরায়ণ মনোভাব এবং প্রত্যেকটি জনসভা থেকে ব্যক্তিগতভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আক্রমণ চালিয়ে যাওয়া। সঙ্গে রয়েছে কুরুচিকর ভাষার ব্যবহার ।
প্রথমত, নন্দীগ্রামে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পায়ে আঘাত লাগার পর পায়ের প্লাস্টার বেঁধে গোটা রাজ্য চষে বেড়িয়েছেন তৃণমূল সুপ্রিমো। তখনই দিলীপ ঘোষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিদান দিলেন বারমুডা পড়ার। রাজনৈতিকভাবে দিলীপ ঘোষের এই বক্তব্য অনেকটাই পেছনে ফেলে দেয় বিজেপিকে। কারণ বিরোধিতা থাকতেই পারে। তাই বলে একজন মহিলাকে এই ভাষায় আক্রমন করা যায় কি?
দ্বিতীয়তঃ শুভেন্দু অধিকারী বিজেপিতে যোগ দিয়ে একের পর এক মমতা বিরোধী মন্তব্য করতে শুরু করলেন। নেত্রীকে সম্বোধন করলেন বেগম হিসেবে। তাতেই বিজেপির উগ্র হিন্দুত্ববাদী মনোভাব প্রকাশ পায়। একের পর এক সাম্প্রদায়িক আক্রমণ শানিয়ে গিয়েছেন শুভেন্দু। যা ভাল চোখে নেননি বিজেপির অনেক সংখ্যালঘু কর্মী। এছাড়াও সাম্প্রদায়িক মন্তব্যের জেরে বিজেপির অনেক হিন্দু ভোট হাতছাড়া হয়েছে। এ কথা স্বীকার করেছেন নন্দীগ্রামের আরএসএএসের বিপুল সংখ্যক নেতৃত্বরা।
তৃতীয়তঃ ভোট প্রচারে গিয়ে একের পর এক হিংসাত্মক কথা বলে গিয়েছেন সায়ন্তন বসু ও রাহুল সিনহা, দিলীপ ঘোষ, কৈলাস বিজয়বর্গীয়,অর্জুন সিং সৌমিত্র খাঁ। এখানেই থেমে থাকেনি তারা। ভোটের ফল প্রকাশের পরেও এই ধরনের মন্তব্য প্রায়শই সংবাদমাধ্যমে করতে দেখা গেছে। তাদের এই বক্তব্যগুলোতেই প্রকাশ পেয়েছিল বিজেপি ক্ষমতায় এলে কি হতে পারে। সেই আন্দাজে ভর করেই পরিবর্তনের পরিবর্তন চেয়েও অনেকেই পিছিয়ে গিয়েছিলেন।
রাজনৈতিক মহলের মতে এই মুহূর্তে বঙ্গ বিজেপির যা পরিস্থিতি তাতে যে কোন মুহূর্তে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়তে পারে সংগঠন। বিগত দিনে বিধানসভায় বিজেপির মুখ ছিলেন মনোজ টিগগা। আজ তিনি নেই। দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতির মাটিতে চষে বেড়ানো বর্ষিয়ান নেতা মুকুল রায় রায়কে দেওয়া হলো না বিরোধী দলনেতার দায়িত্ব। অথচ এই মুকুল রায়ের কাধে ভর দিয়েই লোকসভা নির্বাচনে 2019 সালে 18 টি সিটে পদ্ম ফোটাতে সক্ষম হয়েছিল বিজেপি। তাহলে কেন আড়ালে চলে গেলেন তিনি?
ক্রমে বিজেপির অন্দরে বাড়ছে বিক্ষুব্ধ বিধায়কদের সংখ্যা । অনেকেই ইতিমধ্যে ফিরে আসতে চাইছেন তৃণমূলে। সংখ্যাটা ক্রমেই বাড়ছে। সম্প্রতি বিজেপির উগ্র হিন্দুত্ববাদী এবং কথায় কথায় 356 ধারা দেখানোর জুজু নিয়ে সরব হয়েছেন বিজেপি নেতা রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ও। অনেকেই অবশ্য বলছেন বিলম্বিত বোধোদয়।
তবে পর্যবেক্ষকদের মত যেভাবে বিজেপি এগোচ্ছে তাতে পশ্চিমবঙ্গের পৌরসভা নির্বাচনে ঘুরে দাঁড়ানো তো দূর , আগামী পাঁচ বছরে তাদের নাম নিশান মুছে যাবে পশ্চিমবঙ্গের মাটি থেকে। যদি তা হয়, তার জন্য সম্পূর্ণ দায়ী থাকবেন শুভেন্দু অধিকারী সহ বঙ্গ বিজেপির প্রথম সারির নেতৃত্বে থাকা বেশ কয়েকজন নেতারা। সবটাই সময়ের অপেক্ষা। wait & see…