কেউ তো জানে কিছু….রহস্যময় ভাল্কির ‘খতম’ কাহিনি
কাঁটা ঝোপ পেরিয়ে ওরা এগিয়ে এলো।ঝটপট কাজ সারার নির্দেশ আছে। মুখ চোখ বাঁধা ছেলেটা বুঝে গিয়েছে যা বোঝার।
‘শালা দেরি করছিস কেন? খতম কর শ্রেণীশত্রু।’
বলতে বলতেই তিন জনের ছুরির কোপে লটকে পড়ল ছেলেটা। গোঙাতে গিয়ে কয়েকবার পাল্টি খেয়ে স্থির হয়ে গেল।
রক্তাক্ত হাত গামছায় মুছে, গামছা দিয়েই বডিটা মুড়ে নিচের কাঁটা ঝোপের মাঝে কুয়োটার মধ্যে ফেলে দিয়ে তিনজন একসঙ্গে বলে ওঠে- ‘শ্রেণীশত্রু খতম করো। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক’। ঘন বনের ভিতর সেই শব্দগুলো পাক খেয়ে লম্বা পোড়া ইঁটের বিশাল বুরুজের উপর দিয়ে মিলিয়ে যায়। নিচে অন্ধকার কুয়োর মধ্যে পড়ে থাকে ‘শত্রু’র দেহ।
একটা নয়, দুটো নয়, বেশ কয়েকটা এমন ঘটনার সাক্ষী ভাল্কি রাজার বুরুজ। উল্লিখিত খুনের ঘটনা সত্তর দশকের নকশালবাড়ি আন্দোলনের সময়ের। কৃষি বিপ্লবের নেশায় সশস্ত্র আন্দোলনের খতম অভিযান চলছিল রাজ্য জুড়ে। এর জন্মস্থল উত্তরবঙ্গের দার্জিলিং জেলার নকশালবাড়ি। জোতদারদের বিরুদ্ধে কৃষকদের প্রতিরোধ, পুলিশ অফিসার সোনম ওয়াংদির মৃত্যুর পরবর্তী সময় পশ্চিমবঙ্গ প্রবেশ করেছিল রক্তাক্ত রাজনৈতিক অধ্যায়ে। জনজীবনে ভয়-বোমা পিস্তল ছুরি নিয়ে হামলা, প্রত্যাঘাত ও রাজনৈতিক সংঘাতে জড়িয়ে কংগ্রেস, সিপিআইএম আর নকশালপন্থীরা।
এই রক্তাক্ত সময়ে বর্ধমান (এখন পূর্ব বর্ধমান) জেলায় রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডগুলি বহু আলোচিত। ঠিক তেমনই অনালোচিত কিছু গুপ্ত খুন। যাদের খুন করা হয় তাদের কোনও খোঁজই মেলেনি। খুনিদের কেউ চেনে না। শুধু জঙ্গলাকীর্ণ সাপে কিলবিল করা ভাল্কি রাজার বুরুজ এর নীরব সাক্ষী।
বীরভূম ও বর্ধমান-অজয় নদের দুই পারে ছড়িয়ে থাকা এলাকায় নকশালন্থীদের দাপট ছিল বেশ। কৃষি ভিত্তিক বিপ্লবের আদর্শ স্থান। গ্রামে গ্রামে জমির লড়াইয়ের দুই ধারা চলেছে। কেউ নির্বাচনপন্থী বাম দলের সমর্থক, কেউ বেছে নিয়েছে নির্বাচন বিরোধী সশস্ত্র পথ-নকশালবাড়ি ভিত্তিক অতিবাম তত্ত্ব। ক্ষমতায় কংগ্রেস, তাদের শক্তি জোতদার জমিদার।
রক্তাক্ত সেই রাজনৈতিক সময়ে বীরভূম অতি স্পর্শকাতর। নকশালপন্থীরা সক্রিয় অতিমাত্রায়। সংগঠনের অভ্যন্তরে পুলিশের খোঁচড় বা শ্রেণীশত্রু সন্দেহ যার উপরেই পড়ছে সেই খতম। প্রতিপক্ষদের খুনের তালিকাও কম নেই। অজয় তীরবর্তী গুসকরা হয়ে আউসগ্রাম পর্যন্ত এলাকায় রাজনৈতিক খতম অভিযানের বেশকিছু ঘটনার সাক্ষী বিখ্যাত ভাল্কি রাজার কেল্লা বা বুরুজ।
কত জন শ্রেণীশত্রু এখানে খতম হয়েছে? হিসেব নেই। তবে ভাল্কি বুরুজের আসে পাশের কিছু এলাকায় এখনও শোনা যায় খতম তালিকার রোমহর্ষক কিছু কথা। কেউ নামেনি বুরুজের তলায় সেই কুয়োতে। দশকের পর দশক কেটেছে নিখোঁজ যারা তাদের খোঁজ মেলেনি।
ভাল্কি মাচান-জঙ্গলে ঘেরা গা ছমছমে মঙ্গলকাব্য ভিত্তিক একটি ঐতিহাসিক স্থান। পূর্ব বর্ধমান জেলার নামকরা পর্যটন কেন্দ্র। বর্ধমান-বোলপুর ট্রেন লাইনের গুসকরা স্টেশন থেকে কম বেশি কুড়ি কিলোমিটার দূরে এই বিশাল বুরুজ ও জঙ্গল ঘিরে সত্তর দশকের নকশাল আন্দোলনের রক্তাক্ত খতম পর্ব থমকে রয়েছে।
কেউ বলে ও সবকিছু যা হবার হয়েছিল। পরে বামফ্রন্ট জমানায় এলাকায় পর্যটন গুরুত্ব পেয়েছে। বামফ্রন্ট এখন অতীত। তৃণমূল জমানা চলছে। স্থানীয় পর্যটন টিকে আছে এটুকুই। আর আছে বহু প্রাচীন লৌকিক কাহিনির নায়ক ভাল্কি রাজার কথা, বর্গী হামলার কথা। শুধু নিখোঁজ হয়ে গিয়েছে মাত্র পাঁচ দশকের পুরনো খতম অভিযানের শিকার হওয়া শ্রেণীশত্রুদের পরিচয়।
গা ছম ছম করবে ভাল্কি বুরুজ দেখলে।