২১এর বিধানসভা নির্বাচন আসন্ন, বাম-কংগ্রেস জোটে ফোকাসে অধীর

পার্থ প্রতিম বিশ্বাস, সম্পাদক, পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেস

দীর্ঘ ৩৪ বছরের বাম শাসনে যতবার নির্বাচন এসেছে ততবারই সরকার পরিবর্তনের আশা ও দাবী উঠলেও বাস্তবে সেই বাম সরকারই ক্ষমতায় এসেছে। ফলে অনেকেই এমন ভাবতে শুরু করেছিলেন যে, বাংলা থেকে বামেদের কোনোদিনও সরানো যাবেনা।

দীর্ঘকাল ধরে সরকারী ক্ষমতা ভোগের কারণে বাম কর্মী সমর্থকদের ভেতরেও জমিদারি করার মানসিকতাটা ভয়ঙ্কর রকমের বেড়ে গিয়েছিলো। বাম শাসনের শেষের দিকে রাজ্যের প্রতিটা এলাকাতেই এমন কিছু দাদা তৈরী হয়েছিল যারা অকারণেই মানুষের ওপর অত্যাচার করাটা তাদের পৈতৃক অধিকার বলেই ভেবে নিয়েছিল।

কিন্তু মারে হরি রাখে কে? ২০১১ সালের ১২ই মে বিকালের সাংবাদিক সন্মেলনে বসে বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু যখন অষ্টম বামফ্রন্ট সরকার গঠনের গল্প বলছেন তখনও তিনি জানেননা, “তোমারে বধিবে যে ইভিএম-এ রয়েছে সে”। অষ্টমবার বাম সরকার গঠনের অলীক স্বপ্নকে মুছে মাত্র ৬০টি আসন নিয়েই বিরোধী আসনে বসতে হলো বামেদের। তারপর থেকেই ক্রমশঃ শক্তিক্ষয়।

“হার্মাদ” নামে চিহ্নিত অসংখ্য বাম নেতা কর্মী একে একে নতুন ক্ষমতার ছাতার তলায় ভীড় জমিয়েছে তাদের লালজামা বদল করে। একইসঙ্গে একদা বামেদের ভেতরে চিহ্নিত ও হার্মাদ আখ্যা দেওয়া লোকগুলোকে নিজেদের দলে জায়গা ও ক্ষমতা দিয়ে তৃণমূল নেতৃত্বও প্রমান করেছে, আদর্শ নয় শুধুমাত্র ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য যা করার দরকার তার সবটাই তারা করতে প্রস্তুত।

যারা ভেবেছিলেন, বামেরা ক্ষমতা হারালে ওদের বহু নেতাকর্মীকে হয় খুন হতে হবে অথবা রাজ্য ছেড়ে পালাতে হবে, তাদের সকলকে বোকা বানিয়ে ওই বাম নেতাকর্মীরা আজও বহাল তবিয়তে।

এ রাজ্যে তৃণমূল জমানা শুরুর পর প্রথম দুর্নীতি ত্রিফলা আলো আর নীল সাদা রঙের ব্যাবসা। রাস্তার ধারে অকারণেই বসানো অসংখ্য ত্রিফলা আলোর আদৌ কতটা দরকার ছিলো সেটা আজও বোঝা যায়নি । যদিও সেই ত্রিফলার হাত ধরে সরকারী তহবিল ফালাফালা হয়ে গেছে। এই ত্রিফলা দিয়ে ফিতে কেটে যে দুর্নীতির শুরু করা হয়েছিলো তা বর্তমানে আম্ফানে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের দেওয়া সরকারী সাহায্যে বিরাজ করছে।

এসবের মাঝে চিটফান্ড থেকে কাটমানি-সিন্ডিকেট, বালি-পাথর-চুরি, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষক নিয়োগ, ডোমিসাইল বি সার্টিফিকেট দিয়ে ডাক্তারিতে ভর্তি, “শ্রী” মার্কা প্রকল্পে সাহায্য পাওয়ার আগেই নাম ঢোকাতে “তোলা” নেওয়া থেকে কলেজে ভর্তির সময়ে ছাত্রছাত্রীদের থেকে নেওয়া লক্ষ লক্ষ টাকায় বিদ্যমান। এছাড়াও অপরের সম্পত্তি জোর করে হাতিয়ে নেওয়ার মতো অপরাধও আছে কারও কারও বিরুদ্ধে।

শোনা যায়, প্রথম থেকেই তৃণমূল নেত্রীর দশবছর শাসন করার ইচ্ছা ছিলো। যাতে ওই সময়কালে তিনি ও তাঁর দলের সদস্যরা ফুলেফেঁপে ঢোল হয়ে উঠতে পারেন। সেই দশ বছরের ভেতরে নয় বছর ইতিমধ্যেই অতিক্রান্ত। হাতে মাত্র কয়েকটা মাস।

এদিকে ২০১৪ তে ভারতবর্ষের কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতায় আসা বিজেপি দলও এ বাংলায় ক্ষমতায় আসার জন্য উদগ্রীব হয়ে রয়েছে। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে বাংলা থেকে ১৮ জন সাংসদের জয় পাওয়াটা বিজেপিকে এই স্বপ্ন দেখতে সাহায্য করছে।

যদিও তৃণমূলের চুরি ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেই মানুষ বিকল্প হিসাবে বিজেপিকে বেছে নিয়েছিলো। এছাড়াও লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনের ভিত্তি সম্পূর্ণ আলাদা।

ভারতের অন্য প্রদেশগুলোর সঙ্গে বাংলার অনেক অমিল। বিশেষ করে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এটা ভীষণই বিপরীতমুখী। বিজেপি দল যে সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করে তার সঙ্গে বঙ্গীয় সংস্কৃতি তথা বাঙালী মননের মিলের চাইতে অমিলের পরিমাণ বিস্তর। ফলে বিজেপির বঙ্গবিজয়ের স্বপ্ন হয়তো বাস্তবে অধরাই থেকে যাবে।

যদিও এসব ভেবে বর্তমানে বাংলায় বিজেপি দলকে হেলাফেলাও করা যাবে না। মনে রাখতে হবে, হরিপদ ভারতী, বিষ্ণুকান্ত শাস্ত্রী বা তপন শিকদারের বিজেপি এখন আর নেই। যাদের ভেতরে ধর্মীয় উগ্রতা থাকলেও বঙ্গসংস্কৃতির সঙ্গে যাদের গভীর যোগাযোগ ছিলো।

http://sh103.global.temp.domains/~lyricsin/thequiry/chakraberia-public-durgotsab-is-an-innovative-initiative-to-highlight-the-culture-of-bengal/

আজকের বিজেপি ক্ষমতায় আসতে যা খুশি তাই করতে পারে। জনপ্রতিনিধি কেনা থেকে অহেতুক দাঙ্গা বিবাদ বাঁধানো, সবই ওদের বাঁয়ে হাত-কি খেল। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, এরা আইন, সংবিধান, কিছুই মানেনা। ফলে এদের কাছে সাংবিধানিক ব্যাখ্যা বা বিচার চেয়ে সমাধান আশা করাটাও ভুল। অথচ দেশে সংবিধান মেনেই সব কিছু করার কথা।

স্বাধীনতার পর থেকে চলে আসা পুরো ব্যাবস্থাটাই বিজেপি শাসনের খপ্পরে পড়ে ব-কচ্ছপ মার্কা হয়ে যাওয়ায়, সাময়িক আবেগ সরিয়ে অন্তত পাঁচ বছরের জন্য ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা যারা করবেন, তাদের কাছে বাংলার আগামী বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপিকে ভোট দেওয়ার কোনো সুযোগই নেই।

২০১৯ এর লোকসভা ভোটে যারা বিজেপিকে ভোট দিয়ে তাদের অসন্তোষের বার্তা দিয়েছেন তাদের কাছে এবার পেছন ফিরে হাত শক্ত করার সময় এসেছে। ইতিহাসের গুরুত্ব মেনেও বঙ্গ শাসনে বিজেপি কখনোই তৃণমূলের বিকল্প নয়।

মানুষের দাবী মেনে নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বের হাতে বাংলার দায়িত্ব তুলে দিতে চাইলে, শাসন ব্যাবস্থায় প্রকৃত পরিবর্তন চাইলে তৃণমূলের বিকল্প হিসাবে বর্তমান বাম কংগ্রেস জোটের পক্ষেই জনতাকে রায় দিতে হবে।

এতকিছু পড়ার পর পাঠকের মনে প্রশ্ন আসবে, কেন এই বাম কংগ্রেস? কে ওদের নেতা? কে হবেন মুখ্যমন্ত্রী? এগুলোর কোনোটাই ভুল প্রশ্ন নয়। এতদিনের যুযুধান দুই পক্ষ কীভাবে এক হলো? আর কেনই’বা ওদের সমর্থন করবো? এসব ভাবলে তাকে “অন্যায়” বলা যাবেনা।

এই আলোচনায় এটা অবশ্যই মনে রাখা দরকার, রাজনীতিতে কোনো স্থায়ী বন্ধু বা শত্রু হয়না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সম্পর্কে বদল আসে। ক্ষমতায় থাকার সময় যে বামেদের বিরুদ্ধে কংগ্রেস দলের এত বিদ্বেষ ছিলো ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার পরে কীভাবে

তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব সম্ভব হলো? এসব বলতে বা জানতে হলে পট পরিবর্তনের পরে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর ওপর নজর রাখতে হবে।

একথা অবশ্যই ঠিক যে, দেশে এমন কোনো রাজনৈতিক দল নেই, যে দলের হয় সকলেই ভালো অথবা সকলেই খারাপ। বামেদেরও একাংশ ভালো ছিলেন এবং এখনও আছেন। যে অংশটা ইতিমধ্যেই তৃণমূল ও বিজেপিতে ভিড়েছে, তারা যে খারাপ, তার প্রমান তারা সবসময় স্বার্থ ও লাভের জন্য ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে চেয়েছেন এবং আছেন।

ক্ষমতা না থাকলেও, তারাই চিরকালীন পথ আঁকড়ে থাকেন যাদের ভেতরে নীতি আদর্শ বোধ আছে। কার্যত বামেদের সেই নীতি আদর্শ বোধওয়ালাদের সাথেই জাতীয় কংগ্রেসের জোট হয়েছে। পাঠক মনে রাখবেন, এত অত্যাচার ও ক্ষমতার হাতছানি থাকার পরেও জাতীয় কংগ্রেসের একাংশও কিন্তু আজও তাদের নীতি আদর্শ ছেড়ে অন্য দলে চলে যাননি। ফলে বাংলায় বর্তমান বাম কংগ্রেস জোট আসলে নীতি আদর্শ আছে এমন কিছু মানুষের জোট।

এবারে প্রশ্ন নেতৃত্ব নিয়ে। কে হবেন জোটের মুখ্যমন্ত্রী? একদিকে সুজন চক্রবর্তী,সূর্যকান্ত মিশ্ররা আছেন অন্যদিকে সোমেন মিত্রের চলে যাওয়ার পর  অধীর চৌধুরী, আব্দুল মান্নান ও প্রদীপ ভট্টাচার্যরা রয়েছেন। এখানে আরও একটা বিষয় মনে রাখা দরকার যে, বিষয়টা এখানেই শেষ নয়।

যেহেতু করোনা ও লকডাউনের ফলে চারিদিক থমকে আছে, তাই অনেককিছুই প্রকাশ পাচ্ছে না। সর্বশেষ আম্ফান দুর্নীতির ফলে রাজ্যের বিভিন্নপ্রান্তে প্রকাশ হওয়া জনরোষ বা অসন্তোষ দেখে ভাববেন না, এটা হঠাৎ ঘটা কোনো ঘটনা। আসলে এই জনরোষ দীর্ঘ অবহেলা ও অত্যাচারের ফসল। জেলায় জেলায় যারা তৃণমূলের অন্দরমহলের খবর রাখেন তারা জানেন দলটার আসল অবস্থা কি?

যদিও না আঁচালে বিশ্বাস নেই। তবুও বলা যায় যে, এখন এ রাজ্যে তৃণমূলের অবস্থা, ঘুন ধরা বাঁশের মতো। প্রশান্ত কিশোর বা পিকে যতই চেষ্টা করুন, তার তথাকথিত ম্যাজিক যে এ রাজ্যে চলবে না এবং ওই লোকটির অধীনতা যে তৃণমূলের একাংশ মানছেন না, সেটাও আজ জলের মতো পরিস্কার।

ফলে তৃণমূল দলের ভাঙন অবশ্যম্ভাবী। নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে সেসব ততই প্রকাশ পাবে। ইতিমধ্যেই অনেকেই দল ছাড়ার জন্য মুখিয়ে রয়েছেন বলে তৃণমূলের অন্দরের খবর।

একই সঙ্গে এটাও নিশ্চিত যে, দল ভেঙে আসা এই সব নেতাদের অধিকাংশই বাম কংগ্রেস জোটের সঙ্গে থাকবেন। ফলে যত নির্বাচন এগিয়ে আসবে ততই জোটের পাল্লা ভারী হবে।

“কে হবেন জোটের মুখ্যমন্ত্রী মুখ” এটাই এখন লাখটাকার প্রশ্ন। এক্ষেত্রে নম্র ভদ্র বাম নেতা ডাঃ সূর্যকান্ত মিশ্র ও জাতীয় কংগ্রেস সাংসদ ও প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি  অধীর চৌধুরীর গ্রহণযোগ্যতাই সবচাইতে বেশী। যদিও জেলাগত ক্ষমতার প্রশ্নে ডাঃ মিশ্র বর্তমানে পিছিয়ে আছেন।

গত নির্বাচনে তিনি তাঁর বিধানসভা কেন্দ্র নারায়ণগড়ে হেরেছেন। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলাতেও বামেদের প্রভাব আর আগের মতো নেই। পাশাপাশি ২০১৬ র পর থেকে ক্ষয়প্রাপ্ত মুর্শিদাবাদকে অধীর চৌধুরী আবারও উদ্ধার করতে পেরেছেন। সেই সঙ্গে পাশ্ববর্তী জেলাগুলো সহ সারা বাংলা জুড়েই অধীর চৌধুরীর গ্রহনযোগ্যতা তুঙ্গে। এসবের মূল কারণ তার রবিনহুড ইমেজ।

জাতীয় কংগ্রেস সর্বভারতীয় দল। অধীর চৌধুরী শুধু সাংসদ নন, বর্তমানে তিনি লোকসভায় জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্ব করছেন। অনেক ক্ষমতা অনেক দায়িত্ব। বাংলার শাসনে বদল এলে তাঁর দল তাকে কি ভাবে কোথায় ব্যাবহার করবে সেটাও বাইরে থেকে বলা সম্ভব নয়।

তাই মুখ্যমন্ত্রীত্বের প্রশ্নে দুপক্ষের দুটে নামের ওপরেই নির্বাচকমণ্ডলীকে ভরসা ও বিশ্বাস রাখতে হবে।

বিঃদ্রঃ- প্রতিবেদনে প্রকাশিত বক্তব্য, লেখকের সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত। TheQuiry কোনোভাবেই এর জন্য দায়ী নয়।

সম্পর্কিত পোস্ট