২১ শতকেও পরিবর্ধিত কলম রক্ষার লড়াই

শুভজিৎ চক্রবর্তী

অয্যোধ্যায় রামমন্দির ভুমিপুজার অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর ভাষণে নয়া ভারতের সূচনার কথা বলেছিলেন। কিন্তু যে দেশে সাংবাদিকতার হনন করা হয়, সেই দেশের নতুন করে শুরু করার কিছু রয়েছে? বাক্ স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে গিয়ে ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭ সালে নিজেরই বাড়ির সামনে আততায়ীদের হাতে খুন হতে হয়েছিল কন্নড় ভাষার সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশকে।

স্বাধীনতার পরবর্তীতে বাক্ স্বাধীনতাকে টিকিয়ে রাখার অসীম প্রয়াস করতে গিয়ে বহু মানুষ জেলবন্দী হয়ে রয়েছেন। আবার অনেকে ছাড়াও পেয়েছেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম গোরখপুরের ডাক্তার কাফিল খান। অভিযোগ, আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে হিংসামূলক ভাষন দিচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু উপযুক্ত তথ্যের অভাবে এলাহাবাদ আদালত তাঁকে মুক্তি দেয়।

ঠিক একইভাবে ২০১৮ সালে ভীমা কোরেগাঁও মামলা নিয়ে গোটা দেশ তোলপাড় হয়। গ্রেফতার হন শুধা ভরদ্বাজ, ভারাভারা রাও, অরুণ ফেরারা, গৌতম নাভালকা, সুধীর ধাওলে এবং সুরেন্দ্র গাডলিং সহ নয় জন সমাজকর্মী। চলতি বছরে আনন্দ তেলটুমড়ে এবং এমটি হানিবাবুকে গ্রেফতার হন।

অভিযোগ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে খুনের ছক কষছিলেন এরা৷ ২০১৮ সালে ভিমা কোরেগাঁও মামলার প্রাথমিকভাগে তদন্তের দায়িত্বভার ছিল পুণে পুলিশের। পরে তা এনআইএর হাতে চলে যায়। গত দু বছর ধরে চলা তদন্তের গতি শ্লথ করে দেওয়া হয়।

বাক্ স্বাধীনতার লড়াই করতে গিয়ে বর্ষীয়ান আইনজীবী প্রশান্ত ভুষণকে আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়। আদালতের দেওয়া শাস্তি মেনে নেন তিনি। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের নিয়ে মন্তব্য থেকে পিছু হটতে রাজি হননি বর্ষীয়ান আইনজীবী। বরং তাঁর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হলেও আদালতের দেওয়া শাস্তি মাথা পেতে নেন তিনি।

এখানেই বলা দরকার একুশ শতকে গণতান্ত্রিক ক্ষমতার বলে বলীয়ান হয়েও মানুষ সরকারের লাল চোখকে ভয় পাচ্ছে। ভয় পাচ্ছে এনএসএ এবং ইউএপিএ প্রয়োগ করে জেলবন্দী না হতে হয়! ঠিক যেমনটা দিল্লিতে সিএএ বিরোধী আন্দোলনে শামিল সাফুরা জারগার, মীরান হায়দার, গুলফিসা খাতুন, ইকবাল তানহা এবং দেবাঙ্গনা কালিটার মতো ছাত্র আন্দোলনের প্রথম সারিতে উপস্থিত কিছু ছাত্রছাত্রীদের করা হল।

এতে শুধুমাত্র আন্দোলন স্থিমিত হলনা, বরং বাক্ স্বাধীনতার ওপরেও বিরাট প্রভাব পড়ল। হেট স্পিচ দেওয়ার অভিযোগে জওহরলাল নেহেরুর প্রাক্তন ছাত্রনেতা ওমর খালিদকে গ্রেফতার করা হল।

কথা হচ্ছিল সাংবাদিকতায় বাক্ স্বাধীনতা নিয়ে। হ্যাশট্যাগ এবং ট্রেন্ডিংয়ের দুনিয়ায় কলমের খোঁচায় সরকারকে আক্রমণ এবং বুনিয়াদি স্তরের সাংবাদিকতা হয়তো মুছে যেতে শুরু করেছে।

http://sh103.global.temp.domains/~lyricsin/thequiry/dr-was-awarded-the-cdri-award-for-his-contribution-to-cancer-research-bushra-atiq/

দ্য নিউজ মিনিটে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে বলা হচ্ছে, ২০১৪ সাল থেকে ২০১৯ সাল অবধি ১৯৮ জন সাংবাদিকের ওপর হামলা করা হয়েছে। শুধুমাত্র ২০১৯ সালেই ৩৮ জনের ওপর বড়সড় হামলা চালানো হয়েছিল। মোট ১৯৮ জনের মধ্যে ৪০ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়৷ যার মধ্যে ২১ জনই বলি হয়েছেন সাংবাদিকতার কাজের জন্য।

এরই মধ্যে ৬৩ জনকে সাংবাদিকতার খাতিরে কোনো বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের জন্য হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ। এগুলির মধ্যে ২৫ টি খুনের এফআইআর দায়ের করা হয়েছে৷ দায়ের হওয়া ১৮ টি মামলা এখনও অবধি ঝুলে রয়েছে।

চলতি বছরে কোভিড মহামারির কারণে বহু সাংবাদিক নিজেদের কাজ খুইয়েছেন। কোভিড আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে বহু জনের। ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফি এবং সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত বহু মানুষের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে। এরই মধ্যে বেশ কিছু ঘটনা এখনও শিহরিত করে আমাদের৷

২০১৭ সালে গৌরি লঙ্কেশের মৃত্যু তদন্তের রহস্য এখনও পরিষ্কার করে কিছু বলা সম্ভব নয়। ৯,২৩৫ পাতার চার্জশিটের তদন্ত করতে গিয়ে গতবছর ধানবাদ থেকে একজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

চলতি বছরের মে মাসে দায়ের হওয়া ফাইনাল চার্জশিট জমা করে এসআইটি। গত বছরে ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া শরদ কালস্কারকে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসে৷ এসআইটিকে দেওয়া বয়ানে শরদ জানায়, গৌরী লঙ্কেশকে হত্যার পর মহারাষ্ট্রের ভাসাই লেকে সেই পিস্তল ছুঁড়ে দেয়। এসআইটির তরফে জানানো হয়েছে হত্যার সময় ৭.৬৬ এমএম দেশী পিস্তল ব্যবহার করা হয়।

কলমের প্রতিবাদের যে তীব্রতা রয়েছে তার কোনও বিকল্প হয় না। সাংবাদিকের কাছে কলমই সমাজের আয়না। যেটা দিয়েই চারপাশে ঘটতে থাকা বিভিন্ন ঘটনা তুলে ধরার অনন্ত প্রয়াস চালায় একজন সাংবাদিক। আর সাংবাদিকের সেই কলমকে যখন বন্দুকের নল ঠেকিয়ে অকেজো করে দেওয়া হয়, তখন আদালতে বিচারকের কলমের  ওপর আস্থা রাখতে হয়।

যে আস্থা রাখতে হয়েছিল শফিকুল ইসলামকে, যে আস্থা রাখতে হয়েছিল সন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়কে। দেশের চতুর্থ স্তম্ভের লড়াইয়ে অনেকের পরিণতি গৌরী লঙ্কেশ অথবা কলিবুর্গীর মতো হতে পারে। কিন্তু কলমের লড়াই জারি রেখেছে এখনও অনেকেই। নতুন ভারত-পুরানো ভারত, ট্রেন্ডিং-নন ট্রেন্ডিংয়ের দুনিয়ায় পরিবর্ধিত কলমের জোরেই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন মুষ্টিমেয় সাংবাদিক৷

সম্পর্কিত পোস্ট