সংবিধানে অসুবিধা নেই, হিজাব নিষিদ্ধ হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পুজোও বন্ধ করতে হবে!

দ্য কোয়ারি ওয়েবডেস্কঃ কদিন আগেই সরস্বতী পুজো গেল। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা সহ ভারতের বাঙালি প্রধান এলাকার কমবেশি সব স্কুল-কলেজ এই মহা ধুমধামের সঙ্গে বাগদেবীর আরাধনা করা হয়েছে। এতে নতুন কিছু নেই। দীর্ঘদিন ধরে এই রেওয়াজ চলে আসছে এমনকি দুর্গা পুজোর আগে কারিগরি বিদ্যার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ধুমধামের সঙ্গে বিশ্বকর্মা পুজো হতেও দেখা যায়।

সাধারণ ডিগ্রী কলেজ গুলোতেও বিশ্বকর্মা পুজো হয়। কারণ সেখানে ল্যাবরেটরি থাকায় বেশিরভাগ ছাত্র সংসদ পুজো করে থাকে। এটাই স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু কর্নাটকে শুরু হওয়া সম্প্রতি হিজাব বিতর্ক এই স্বাভাবিক অবস্থাই সম্পূর্ণ বদলে দিতে পারে।

ডিসেম্বর মাস থেকে কর্নাটকে হিজাব নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। কিন্তু প্রায় মাস দু’য়েক ধরে ঢিমে আঁচে বিতর্ক চলতে থাকলেও তা এখন দাবানলের চেহারা নিয়েছে। এমনকি পুদুচেরি, মধ্যপ্রদেশেও এই বিতর্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এই বিতর্ক এতটাই মারাত্মক আকার ধারণ করেছে যে উত্তরপ্রদেশ সহ পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা ভোট পর্যন্ত কিছুটা আলোচনার পিছনের সারিতে চলে গিয়েছে। কর্ণাটক সরকার বাধ্য হয়েছে তিন দিনের জন্য রাজ্যের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে। কিন্তু কেন?

আমাদের রাজ্যের মতোই কর্নাটকের‌ও বেশকিছু মুসলমান ছাত্রী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হিজাব পড়ে ক্লাস করে। দীর্ঘদিন ধরে এটা চলে আসছে। কিন্তু ডিসেম্বর মাসে হঠাৎই সে রাজ্যের কিছু হিন্দুত্ববাদী সংগঠন দাবি করতে শুরু করে হিজাব পড়ে ক্লাস করতে দেওয়া চলবে না। তাতে নাকি পড়ুয়াদের মধ্যে সমতা বজায় থাকে না। একটি নির্দিষ্ট ধর্মের পড়ুয়ারা অতিরিক্ত প্রাধান্য পায়।

অরুণাচলে তুষারধসে ৭ সেনার মৃত্যু, শোকপ্রকাশ মুখ্যমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির

হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির এই দাবির মুখে পড়ে কর্নাটকের বেশকিছু কলেজ হিজাব পড়ে ক্লাসে ঢোকা, এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রবেশ করার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বিবৃতি দিয়ে জানায় নির্দিষ্ট ড্রেসকোড মেনেই সকলকে ক্লাস করতে হবে। কোন‌ও ধর্মীয় চিহ্ন বহনকারী পোষাক পরা চলবে না। এতেই হিজাব নিষিদ্ধ হলেও সংখ্যাগুরু হিন্দু সম্প্রদায়ের যে পড়ুয়ারা কপালে তিলক কেটে ক্লাসে আসে তাদের কোনরকম বাধা দেওয়া হয়নি।

এই ঘটনার পর মুসলিম ছাত্রীরা প্রতিবাদ জানাতে শুরু করে। ৫ ফেব্রুয়ারি কর্ণাটক সরকারের শিক্ষা দফতর একটি বিবৃতি জারি করে জানায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়ম মেনেই সকলকে ক্লাস করতে হবে। অর্থাৎ সরাসরি না বললেও তারা হিজাব নিষিদ্ধ করার পক্ষে মত দিয়েছে। একদল ছাত্রী এই বিতর্ক চলাকালীন গলায় গেরুয়া স্কার্ফ পরে জয় শ্রীরাম বলতে বলতে রাস্তা দিয়ে হেঁটে মিছিল করে যায়।

এরপরই গোটা বিতর্ক অন্য মাত্রা পেয়ে যায়। যেখানেই মুসলিম ছাত্রীরা হিজাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে সেখানেই হাজির হয়ে জয় শ্রীরাম স্লোগান তুলেছে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ছাত্র-ছাত্রীরা। অভিযোগ উঠেছে বেশ কিছু ক্ষেত্রে পড়ুয়াদের দলে বাইরের লোকজনকেও সামিল হয়ে জয় শ্রীরাম স্লোগান দিতে দেখা গিয়েছে। ঘটনাক্রম থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার, হিজাব বিতর্ক ঘিরে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ শুরু হয়েছে কর্ণাটকজুড়ে।

এই পরিস্থিতিতে বেঙ্গালুরু হাইকোর্টে মামলা দায়ের হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই হিজাব বিতর্ক নিয়ে সংবিধান বা আইন কি বলছে?

সংবিধানের একাধিক জায়গায় লেখা আছে প্রত্যেকের ধর্মাচরণের স্বাধীনতা আছে। অর্থাৎ অন্যের অসুবিধা না করে প্রত্যেকেই নিজের ধর্মীয় বোধ অনুযায়ী পোষাক পরতে পারে। কিন্তু সরকার বা প্রশাসন নির্দিষ্ট কোন‌ও ধর্মের পক্ষপাতিত্ব করবে না। সে দিক থেকে দেখতে গেলে হিজাব একটি পোশাক ছাড়া আর কিছুই নয়। কোনও মুসলিম ছাত্রী যদি তার মাথা ঢেকে ধর্মীয় বিধি মেনে ক্লাস করে তাতে আইন ভঙ্গ যেমন হয় না তেমনই অনৈতিক কিছু নেই।

তারপরও কেউ কেউ বলছেন এই একবিংশ শতকে এসে ধর্মীয় পরিচয় বহনকারী পোষাক পড়ে পড়ুয়ারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাবে তা মেনে নেওয়া যায় না। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের ‘সিউডো সেকুলার’ অংশ‌ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হিজাব নিষিদ্ধ করার পক্ষে মত দিয়েছে। কিন্তু তারা শিখদের পাগড়ি বা হিন্দু সম্প্রদায়ের যে পড়ুয়ারা মাথায় টিকি রেখে বা কপালে তিলক কেটে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যান তার বিরোধীতা করেননি।

এদিকে বাংলার বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরস্বতী পুজো হয়। আবার কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিশ্বকর্মা পুজো অতিপরিচিত ঘটনা। এক্ষেত্রে মুসলিম ছাত্রীদের হিজাব নিষিদ্ধ করে থেমে গেলে হবে না। সেক্ষেত্রে পাগড়ি যেমন নিষিদ্ধ করতে হবে, তেমনই কপালে তিলক কাটা, বা টিকি রাখাও বন্ধ করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোন‌ও ধর্মীয় আচরণ পালন করাও বন্ধ করে দিতে হবে।

কিন্তু গোটা ঘটনাক্রম থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার, কর্ণাটক সরকার সরাসরি নির্দিষ্ট কোনও অবস্থান না নিলেও তারা হিন্দু মৌলবাদীদের পক্ষে বিশেষভাবে দুর্বল। রাজনৈতিক কারণে কর্নাটকের বিজেপি সরকার যে এই আচরণ করবে সেটাই স্বাভাবিক।

এই পরিস্থিতিতে মুসলিম সম্প্রদায়ের ছাত্রছাত্রীরা যে প্রতিবাদের পথে হেঁটেছে তা খুব স্বাভাবিক। কারণ একতরফাভাবে যদি হিজাব নিষিদ্ধ করা হয় তবে তা সম্পূর্ণভাবে সংখ্যালঘুর ওপর সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্যের পরিচয় হয়ে থাকবে। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মতো এটাও স্বাধীন ভারতের আরেকটি কালো অধ্যায়ে পরিণত হতে পারে।

হিজাব নিয়ে কর্নাটকের হিন্দু মৌলবাদীরা যেভাবে জয় শ্রীরাম ধ্বনি দিচ্ছে তার পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় আল্লাহু আকবার ধ্বনি উঠেছে। উত্তেজনার বশে এটা হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে জয়শ্রী রামের পাল্টা কোন‌ও ধর্মীয় স্লোগান না দিয়ে প্রতিবাদের পথে হাঁটাটাই সঠিক পদক্ষেপ হবে। কারণ সম্পূর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থেই এই ধর্মীয় মেরুকরণ করতে চাইছে হিন্দু মৌলবাদীরা।

তাই তাদের জয় শ্রী রামের পাল্টা আল্লাহু আকবর বলা মানে সেই ফাঁদে পা দেওয়া। এতে ধর্মীয় মেরুকরণ আরও গতি পাবে। যদিও বিজেপি সরকারের আমলে আদৌ মুসলিম ছাত্রীরা ন্যায়বিচার পাবে কিনা তা নিয়ে সংশয় আছে!

এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন আছে। দীর্ঘদিন ধরে তো একটা বিষয় চলে আসছিল। হঠাৎ তা উস্কে উঠল কেন? সম্ভবত উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা ভোটে ধর্মীয় মেরুকরণ চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যেতেই কর্নাটকে পরিকল্পিতভাবে হিজাব বিতর্ক তৈরি করা হয়েছে। সবটাই আসলে বিজেপি সহযোগী সংগঠনগুলির এক ছক। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ও ঐক্য মনোভাবাপন্ন মানুষদের এই সময় আরও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত।

তাদের আরও বেশি করে বোঝানো প্রয়োজন, ধর্ম কোন‌ও বিষয় নয়। বেকারের হাতে কাজ, গরিবের পেটে ভাত‌ই হল আসল ইস্যু। রাজা তার গদি সুরক্ষিত রাখতে এই আসল সমস্যাগুলি থেকে নজর সরিয়ে ধর্মীয় বিভাজনে মাতিয়ে রাখতে চায় প্রজাদের। এই হিজাব বিতর্ক সেইরকমই একটা বিষয়!

সম্পর্কিত পোস্ট