গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে দীর্ণ কোচবিহারে ফ্যাক্টর রবি ঘোষ, লোকসভার আগে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পারে তৃণমূল

দ্য কোয়ারি ওয়েবডেস্কঃ কোচবিহার জেলা মানেই শাসকদলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ইতিহাস। বাম জমানায় কোচবিহারে সিপিএমের পাশাপাশি সমান দাপট ছিল শরিক ফরওয়ার্ড ব্লকের। কিন্তু কমল গুহ বনাম অমর রায় প্রধান, পরেশ অধিকারী বনাম গোবিন্দ রায় এমনই একাধিক শিবিরে বিভক্ত ছিল ফরওয়ার্ড ব্লক।

ফলে বাম জামানাতেই এই জেলায় একাধিকবার ভাঙন ও পুনর্গঠন হয়েছে ফরওয়ার্ড ব্লকের। তাছাড়া এই শরিক দলের সঙ্গে জেলায় সিপিএমের বিবাদ তো সর্বজনবিদিত ঘটনা। পরে তৃণমূল রাজ্যের ক্ষমতা দখলের পর‌ও এই ছবি বদলায়নি। কোচবিহারে বর্তমান শাসকদল অসংখ্য গোষ্ঠীতে বিভক্ত। দলের জেলা সভাপতির সঙ্গে জেলা কমিটির চেয়ারম্যানের, বিধায়কের সঙ্গে সাংসদের, পুরপ্রধানের সঙ্গে বিধায়কের বিবাদ নিয়মিত ঘটনা।

কোচবিহারে দলেরেই অন্তর্দ্বন্দ্ব ঠেকাতে একাধিকবার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বারবার কড়া হাতে হাল ধরতে চেয়েছেন। জেলা সভাপতি পদে নতুন মুখ নিয়ে এসেছেন, কখনও আবার অভিজ্ঞ নেতাকে দায়িত্ব দিয়েছেন। কিন্তু পরিস্থিতি বিশেষ একটা বদলায়নি।

সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচন এবং একুশের বিধানসভা নির্বাচনে উত্তরবঙ্গের এই জেলায় তৃণমূল মুখ থুবড়ে পড়ার পরেও দলের নেতাদের বোধোদয় হয়নি। প্রকাশ্যেই তাঁরা একে অপরের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়ে চলেছেন। কখনও আবার নেতাদের অনুগামীরা নিজেদের মধ্যে লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে ১৯ এর লোকসভা ভোটে জেলার রাজবংশীরা বিজেপির দিকে সরে গিয়েছিল এটা যেমন ঠিক, তেমনই তৃণমূলের পরাজয়ের পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ দলের বেলাগাম গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। তাই ২১ এর বিধানসভা নির্বাচনেও শত চেষ্টা করেও এই জেলায় ভালো ফল করতে পারেনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল। কোচবিহারের ৯ টি বিধানসভা কেন্দ্রের ৭ টা তেই জয়ী হয় বিজেপি। কোনরকমে সিতাই ও মেখলিগঞ্জ ধরে রাখে তারা। পরে উপনির্বাচনে দিনহাটায় জয়ী হন উদয়ন গুহ।

পুরনো তে অনাস্থা ‍? বিপুল সাফল্য সত্বেও তৃণমূলের দল ভাঙানো নিয়ে একগুচ্ছ প্রশ্ন

বিধানসভা নির্বাচনে নাটাবাড়ি কেন্দ্রে বর্ষিয়ান তৃণমূল নেতা রবীন্দ্রনাথ ঘোষের পরাজয় বড় ধাক্কা দিয়েছিল তৃণমূল সুপ্রিমোকে। কারণ কংগ্রেসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লড়াই শুরুর একেবারে প্রথম দিনের সঙ্গী তিনি। বরাবর মমতার পাশে পাশে চলেছেন রবি ঘোষ।

উত্তরবঙ্গ জুড়ে তাঁর অবদানের কথা মমতা ভালোই জানেন। তাই রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর রবীন্দ্রনাথ ঘোষের হাতেই একটা বড় সময়জুড়ে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দফতরের দায়িত্ব দিয়ে রাখেন তিনি। তাতে তুলনায় অনুন্নত উত্তরবঙ্গে ব্যাপক কাজ হয়েছে। রাস্তাঘাট তৈরি, পানীয় জলের সংযোগ, সুফল বাংলায় দরিদ্রদের বাড়ি তৈরি করে দেওয়া, বিভিন্ন পরিকাঠামো গড়ে তোলার মতো কাজ তিনি সাফল্যের সঙ্গে করেন।

২০১১ ও ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে নাটাবাড়ি কেন্দ্র থেকে জয়ী হন রবীন্দ্রনাথ ঘোষ। কিন্তু দলের অন্যান্য নেতাদের মধ্যে বিরোধের কারণে নিচুতলার তৃণমূল কর্মীদের একটা বড় অংশ ধীরে ধীরে দলের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠে। সেই সঙ্গে বিজেপি বিভাজনের রাজনীতি করে জেলার রাজবংশীদের ভুল বুঝিয়ে নিজেদের দিকে টেনে আনে। তার ফলেই ব্যাপক পরিশ্রম সত্ত্বেও একুশের বিধানসভা নির্বাচনে নাটাবাড়িতে পরাজিত হন রবীন্দ্রনাথ।

তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভালই বুঝেছিলেন তাঁর মতো এমন গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে। না হলে কোচবিহারে তৃণমূল আরও বিপাকে পড়বে। তাই নাটাবাড়ি থেকে সরিয়ে এনে কোচবিহার পুর এলাকার ভোটার করেন রবীন্দ্রনাথ ঘোষকে। তাঁর নেতৃত্বেই পুর নির্বাচনে লড়াই করে তৃণমূল।

কোচবিহারে তেমন কোনও অশান্তিও হয়নি পুরভোটে। রবীন্দ্রনাথ ঘোষের নেতৃত্বে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন পরিচালিত হয়। তাঁর সুদক্ষ নেতৃত্বেই এই পুরসভায় জয়ী হয় শাসকদল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথ ঘোষকেই কোচবিহারের পুরপ্রধান করেন।

দিনহাটা বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনের যেখানে শাসকদলের বিরুদ্ধে ব্যাপক অশান্তি, ভোট লুটের অভিযোগ উঠেছে সেখানে কোচবিহারে রবীন্দ্রনাথ ঘোষের জন্যই বিরোধীরা অনিয়মের তেমন কোনও অভিযোগ তুলতে পারেনি। পুরপ্রধান হ‌ওয়ার পর বিরোধীদের যথোপযুক্ত মর্যাদা দিয়ে চলেছেন তিনি। পুরসভার বোর্ড মিটিংয়ে বিরোধীদের সঙ্গে নিয়েই যাবতীয় সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। এভাবেই জেলার সদর শহরের উন্নয়নের কাজ এগিয়ে চলেছে।

আগামী বছরই রাজ্যের পঞ্চায়েত নির্বাচন। কোচবিহার জেলার বেশিরভাগ এলাকা পঞ্চায়েতের অন্তর্গত। তাছাড়া তার পরের বছরই আবার গুরুত্বপূর্ণ লোকসভা নির্বাচন। এই দুই নির্বাচনে কোচবিহারে ভালো ফল করতে হলে এবং লোকসভা কেন্দ্রটি বিজেপির হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে হলে এখন থেকেই কৌশল সাজাতে হবে তৃণমূলকে।

সূত্রের খবর বিষয়টি নিয়ে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব ভাবনাচিন্তা শুরু করে দিয়েছে। পঞ্চায়েত ও লোকসভা ভোটের দিকে তাকিয়ে তারা জেলা সংগঠনের খোলনলচে দ্রুত বদলে ফেলতে পারে। সেক্ষেত্রে কোচবিহার জেলায় দলকে পুনরুদ্ধারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব বর্তাতে পারে রবি ঘোষের উপর।

সম্পর্কিত পোস্ট