দীর্ঘ ওঠাপড়ার ঐতিহ্যমণ্ডিত ত্রিপুরায় তৃণমূলের চালকের আসনে রাজীব

দ্য কোয়ারি ওয়েবডেস্কঃ দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় উত্তর-পূর্বের ত্রিপুরা একটি স্বাধীন রাজ্য ছিল। ব্রিটিশ শাসিত রাজ্য হলেও সেই সময় তার কাছে সুযোগ ছিল পাকিস্তান ও ভারত মধ্যে যেকোনও একটিতে যুক্ত হ‌ওয়ার।

মানিক্য রাজপরিবারে এই নিয়ে মতবিরোধ‌ও দেখা দিয়েছিল। উল্লেখ্য প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছরের মানিক্য রাজপরিবারে বারবার উত্তরাধিকার নিয়ে বিবাদ দেখা গিয়েছে। এই সেই বিরল রাজপরিবার যেখানে বেশিরভাগ রাজাই বিভিন্ন দফায় রাজত্ব সামলেছেন।

১৯৪৭ সালে যখন দেশ স্বাধীন হয় তখন ত্রিপুরার রাজা কিরীট বিক্রম কিশোর নাবালক ছিলেন। তাই তাঁর পরিবর্তে মহারানী কাঞ্চন প্রভাদেবী রিজেন্ট কাউন্সিলের সভাপতি হিসেবে দিল্লিতে গিয়ে ভারতীয় ইউনিয়নে যোগ দেওয়ার জন্য স্বাক্ষর করেন। তিনি রাজপরিবারের অনেক বয়স্ক সদস্যের উল্টো পথে হেঁটেছিলেন।

১৯৪৯ সালে ত্রিপুরাকে ভারতের একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করা হয়। ১৯৬৩ সালে পূর্ণাঙ্গ রাজ্যের মর্যাদা পায়। ত্রিপুরার প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন জাতীয় কংগ্রেসের শচীন লাল সিং। বরাবরের স্বাধীনচেতা শচীন লাল অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন ত্রিপুরার মানুষের কাছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি সবরকমভাবে পূর্ববঙ্গের মানুষের পাশে এসে দাঁড়ান।

তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা এতই বেশি ছিল যে ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধাচারণ করতেও পিছপা হননি। জরুরি অবস্থার প্রতিবাদে বাবু জগজীবন রামের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিনি কংগ্রেস ফর ডেমোক্রেসি দলেও যোগ দেন। তাঁর আমলে ত্রিপুরার প্রভূত উন্নতি হয়। রাজ্যে বাঙালি ও উপজাতিদের মধ্যে সম্প্রীতিও ছিল যথেষ্ট। তাঁর পুত্র আশিস লাল সিং এখন ত্রিপুরার শীর্ষস্থানীয় তৃণমূল নেতা।

শচীন লাল সিংয়ে পর অল্প কয়েক মাস করে ত্রিপুরার ক্ষমতায় ছিল জনতা পার্টি ও কংগ্রেস ফর ডেমোক্রেসি। তারপর রাষ্ট্রপতি শাসনের অধ্যায় পেরিয়ে ১৯৭৮ সালে উত্তর-পূর্বের এই রাজ্যটিতে শুরু হয় বাম জামানা। মুখ্যমন্ত্রী হন দোর্দণ্ডপ্রতাপ সিপিএম নেতা নৃপেন চক্রবর্তী। এই সময়ই উপজাতিদের আন্দোলন মাথাচাড়া দেয়।

১৯৮৮ সাল পর্যন্ত দু’দফায় ত্রিপুরা শাসন করে বামেরা। এই সময় প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শচীন লাল সিং ও অসমের দোর্দণ্ড প্রতাপ কংগ্রেস নেতা সন্তোষ মোহন দেব একত্রে বামেদের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলেন। তাঁদের মিলিত প্রয়াসেই ত্রিপুরার ক্ষমতা হারায় বামেরা। আবার ক্ষমতায় আসে কংগ্রেস। মুখ্যমন্ত্রী হন সুধীর রঞ্জন মজুমদার। তিনি চার বছর মুখ্যমন্ত্রী থাকার পর সমীর রঞ্জন বর্মণকে মুখ্যমন্ত্রী করে কংগ্রেস।

এরপর ফের ত্রিপুরার ক্ষমতায় ফেরে বামেরা। মুখ্যমন্ত্রী হন রাজ্যের প্রধান উপজাতি ত্রিপুরী জনগোষ্ঠীর দশরথ দেব। ত্রিপুরার ইতিহাসে এখনও পর্যন্ত তিনি একমাত্র উপজাতি মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর জন্য সে রাজ্যের উপজাতি মানুষ দীর্ঘদিন বামেদের ঢেলে ভোট দিয়েছে।

বামেরাও উপজাতি কল্যাণের জন্য ‘ত্রিপুরা উপজাতি এলাকা স্বশাসিত জেলা পরিষদ’ সংক্ষেপে টিটিএএডিসি গঠন করে। ফলে পৃথক তিপ্রা ল্যান্ডের আন্দোলনকে সাময়িকভাবে দমিয়ে দেওয়া গিয়েছিল। কিন্তু টিটিএএডিসি’তে লাগামছাড়া দুর্নীতি ও উন্নয়নমূলক কাজের বদলে অতিরিক্ত রাজনৈতিক হিসেব-নিকেশের জেরে ফের ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন উপজাতিদের একাংশ।

রাজ্যজুড়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপ বৃদ্ধি পায়। বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলির আক্রমণের জবাবে ত্রিপুরা জুড়ে পাল্টা খুনের রাজনীতি শুরু করে সিপিএম। ইতিমধ্যেই দশরথ দেবের পর মুখ্যমন্ত্রী হন মানিক সরকার।

ব্যক্তিগত স্বচ্ছ ভাবমূর্তি মানিক সরকার ত্রিপুরার উন্নয়নের জন্য অনেক কিছু করলেও নিজের দলের খুনের রাজনীতি বন্ধ করতে ব্যর্থ হন। উল্টে তাঁদের সমাজতন্ত্রের স্বপ্নে বিভোর থাকার সুযোগ নিয়ে গোটা রাজ্যে সংগঠন গড়ে তোলে আরএসএস।

দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার সুবাদে সিপিএম প্রথমে কিছুই বুঝতে পারেনি। কারণ ততদিনে নিচুতলার সঙ্গে তাদের যাবতীয় সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। পরে যখন টনক নড়ে তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। টানা ২৫ বছর তারা ক্ষমতায় থাকার পর ২০১৮ এর বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি জোটের কাছে গো হারান হেরে যায় বামেরা।

এক্ষেত্রে ত্রিপুরার রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে বিজেপিকে ভালোবেসে খুব অল্প মানুষ ভোট দিয়েছে। বেশিরভাগই ভোট দিয়েছিল বাম শাসনের অচলায়তন ভাঙতে। তবে উপজাতি প্রধান দল আইপিএফটি’র সঙ্গে জোট বেঁধে ক্ষমতায় এলেও গত চার বছরে ত্রিপুরার মানুষের জন্য প্রায় কিছুই করে উঠতে পারেনি বিপ্লব দেব সরকার।

শরিক দল আইপিএফটি পৃথক তিপ্রা ল্যান্ডের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু তাদের নেতারা সরকারের ক্ষমতা ভোগ করতে এতটাই ব্যস্ত যে সেই বিষয়ে রাজ্য বা কেন্দ্রের সঙ্গে গত চার বছরে একবারও আলোচনা করে উঠতে পারেনি।

যার ফল টিটিএএডিসি’র নির্বাচনে হাতেনাতে পেয়েছে আইপিএফটি। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ২৮ আসনের টিটিএএডিসি’তে বামেরা একেবারে শূন্য হয়ে গিয়েছে। উল্টে ১৭ টি আসনে জিতে ক্ষমতা দখল করেছে ত্রিপুরা রাজবংশের শেষ প্রতিনিধি প্রদ্যুৎ কিশোর মানিক্যের তিপ্রা মথা নামক সদ্য গঠিত রাজনৈতিক দল।

এক্ষেত্রে লক্ষণীয় ২০১৮ এর বিধানসভা ভোটের আগে বিপ্লব দেব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ত্রিপুরায় ক্ষমতায় এলে তাঁরা উন্নয়নের জোয়ার নিয়ে আসবেন। রাজ্যের ভয়াবহ বেকার সমস্যার চটজলদি সমাধান করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। উপজাতিরা মাথা উঁচু করে বাঁচার অধিকার পাবে এমনটাই বলা হয়েছিল বিজেপির পক্ষ থেকে।

বিপ্লব দেব সরকার সরাতে ত্রিপুরায় তৃণমূলের চালকের আসনে রাজীব

কিন্তু চার বছর পেরিয়ে গিয়েছে। বছর ঘুরলেই ত্রিপুরার আরও একটি বিধানসভা ভোট। কিন্তু রাজ্যের বেকার সমস্যার সমাধানতো হয়ইনি, উল্টে আরও বেড়েছে সেই সমস্যা। এমনকি সরকারি কর্মচারীদের নানানভাবে অতিষ্ঠ করে তুলেছে বিপ্লব দেব সরকার।

ত্রিপুরায় তৃণমূলের চালকের আসনে রাজীব

রাজ্যের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভয়াবহ। মানুষের জন্য কোন‌ও সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প নেই। দরিদ্রতা চরমে উঠেছে। এদিকে উপজাতিদের নিয়েও ধর্মের রাজনীতি শুরু করেছে বিজেপি।

এই পরিস্থিতিতে সিপিএমের সামনে সুবর্ণ সুযোগ ছিল ত্রিপুরার মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বিজেপি সরকার বিরোধী তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলার। কিন্তু তাদের পাশে সেভাবে মানুষ নেই। কারণ বিজেপির শাসনে অতিষ্ঠ হলেও বাম জামানার রক্তস্নাত দিনগুলি কেউ ভুলে যায়নি। এদিকে পাশে মানুষ না থাকায় এবং দলীয় সংগঠনে ক্ষয় ধরায় সিপিএম একরকম হাত গুটিয়ে বসে আছে।

এই পরিস্থিতিতে ত্রিপুরার মানুষের পাশে এসে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলার সঙ্গে উত্তর-পূর্বের এই পাহাড়ী রাজ্যটির সাংস্কৃতিক মিল প্রচুর। সেখানেও বাংলাভাষীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাছাড়া পশ্চিমবঙ্গে অসংখ্য উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ আছে। তাই ত্রিপুরার সমস্যা ভালোই বুঝতে পেরেছিলেন তৃণমূলনেত্রী।

অভিষেকের রাজনৈতিক দক্ষতায় প্রশ্ন, ঘুরপথে দলের অসম্মান; ‘রাজীব’ জ্বরে কাবু দুঁদে কল্যাণ

গতবছর বাংলার মহাগুরুত্বপূর্ণ বিধানসভা নির্বাচনের পর্ব পেরোতেই ত্রিপুরার মানুষকে মুক্তি দেওয়ার লক্ষ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে তৃণমূল। সিদ্ধান্ত নেয় আগে মানুষের মনে আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে। গড়ে তোলে দুর্বার আন্দোলন।

আর এই আন্দোলনকে সঠিক দিশায় এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয় বাংলার প্রাক্তন মন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর। রাজনৈতিক ওঠাপড়ার ইতিহাসে তৃণমূল সু্প্রিমো ত্রিপুরায় তৃণমূলের চালকের আসনে রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বেই ভরসা রাখলেন। 

রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় বর্তমানে দলীয় নেতৃত্বের নির্দেশে ও ত্রিপুরায় সংগঠন গড়ে তোলার জন্য দীর্ঘদিন ধরে সেখানে পড়ে আছেন। মূলত তাঁর পরিচালনায় ও সে রাজ্যের তৃণমূল নেতাদের উদ্যোগে আগরতলা পুরভোটে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসে তৃণমূল। মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে বামেরা নেমে যায় তৃতীয় স্থানে। ত্রিপুরায় সংগঠন গড়ে তোলার কাজ শুরুর মাত্র তিন মাসের মধ্যে তাদের এই সাফল্য সত্যিই অভাবনীয়।

ঐতিহ্যমণ্ডিত ত্রিপুরায় তৃণমূলের চালকের আসনে রাজীব

তবে ত্রিপুরায় তৃণমূলের এই লড়াই মোটেও সহজ হচ্ছে না। বারবার বিপ্লব দেবের বাহিনীর নির্লজ্জ আক্রমণের মুখে পড়তে হচ্ছে তাদের। একদিকে দলীয় কর্মী সমর্থকদের রক্ষা করা, অন্যদিকে বিজেপির আক্রমণের পাল্টা জবাব দেওয়া, এক্ষেত্রে মহাগুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন রাজীব। তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে দেওয়া নেতৃত্বে উজ্জীবিত কর্মী-সমর্থকরা।

এরই মাঝে বিজেপির আক্রমণে গুরুতর আহত তৃণমূল কর্মী মুজিবর ইসলাম মজুমদারের মৃত্যু হয় কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে। তাঁর মৃত্যুর জেরে প্রবল আবেগ তৈরি হয়েছে ত্রিপুরার মানুষের মনে।

একজন নিরাপরাধ তৃণমূল কর্মীর এইভাবে খুন হয়ে যাওয়া মানতে পারছেন না কেউ। মানুষের সেই আবেগকে যোগ্য সন্মান দিতে প্রবল আন্দোলন গড়ে তুলেছে ত্রিপুরা তৃণমূল। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে সঠিক দিশায় সেই আন্দোলন পরিচালনা করছেন রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়।

আগামী বছরের বিধানসভা ভোটের আগে তৃণমূল নেতৃত্ব ত্রিপুরায় দলের সংগঠনকে মজবুত করতে আরও বেশ কিছুটা সময় পেয়ে যাবে। এক্ষেত্রে রাজীবের সাংগঠনিক দক্ষতা তাদের অন্যতম তুরুপের তাস হতে চলেছে। বিশেষত ত্রিপুরার পুরনো এবং নতুন আসা তৃণমূল কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে বাংলার প্রাক্তন মন্ত্রী অত্যন্ত মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন।

আপাতত উত্তর-পূর্বের এই পাহাড়ী রাজ্যের যা পরিস্থিতি তাতে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির নেতৃত্বাধীন রাষ্ট্রীয় শক্তির সঙ্গে সরাসরি লড়াই হতে চলেছে তৃণমূলের। বাংলার শাসক দলের সবচেয়ে প্লাস পয়েন্ট হল তারা কোন‌ও আকাশকুসুম প্রতিশ্রুতি নয়, বরং রাজ্যে আইন-শৃংখলার শাসন ফিরিয়ে এনে বাংলার ধাঁচে উন্নতির প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

তৃণমূলের বিভিন্ন কার্যকলাপ থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার সে রাজ্যের মানুষ যদি তাদের উপর আস্থা রাখে তবে সেই প্রতিশ্রুতি তারা পালন করেই ছাড়বে। এক্ষেত্রে রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকা অনেকটাই গাড়ির ড্রাইভারের মতো। তাঁর দিকনির্দেশেই এগিয়ে চলেছে তৃণমূল কর্মীরা।

সম্পর্কিত পোস্ট