খেলা-মেলা বন্ধের পক্ষে অভিষেক, তবু হচ্ছে গঙ্গাসাগর! দ্বিচারিতা নাকি রাজনীতি?
দ্য কোয়ারি ওয়েবডেস্ক: শনিবার সন্ধেয় প্রকাশিত বুলেটিন থেকে জানা গিয়েছে রাজ্যে দৈনিক সংক্রমণ প্রায় ১৯ হাজারের দোরগোড়ায়। অর্থাৎ এক ধাক্কায় তিন হাজারেরও বেশি দৈনিক সংক্রমণের বৃদ্ধি ঘটেছে। গোটা দেশের পরিস্থিতিও ভয়াবহ।
এরই মধ্যে আবার জাতীয় নির্বাচন কমিশন উত্তরপ্রদেশ সহ পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা ভোটের নির্ঘণ্ট ঘোষণা করে দিয়েছে। দেশের সবচেয়ে বড় রাজ্য উত্তরপ্রদেশে সাত দফায় নির্বাচন হবে। এতে আশঙ্কার প্রমাদ গুনছেন চিকিৎসকদের একাংশ।
আগামী কিছুদিনের মধ্যে পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে এই ভাবনা গাড় কুয়াশার মতো আচ্ছন্ন করে ফেলেছে মানুষের মন। তারই মধ্যে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একগুচ্ছ ঘোষণা নতুন করে লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা যোগাতে পারে অনেককে।
যখন অন্যান্য রাজনৈতিক নেতারা প্রায় কেউই করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন না, তখন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্ট জানালেন তিনি আগামী দু’মাস কোনও রাজনৈতিক সমাবেশে অংশ নেবেন না। এমনকি এখন সময়টা মেলা, খেলা, নির্বাচনের নয় বলেও তিনি নিজের ব্যক্তিগত মত প্রকাশ্যে জানান।
কলকাতা লাগোয়া দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলাতেও সংক্রমণ ভয়াবহ আকারে বাড়ছে। বিশেষ করে কলকাতা সংলগ্ন বিধানসভাগুলিতে সংক্রমণ বৃদ্ধির হার মারাত্মক। এরই মাঝে শনিবার থেকেই সরকারিভাবে শুরু হয়ে গেল গঙ্গাসাগর মেলা।
এই পরিস্থিতিতে করোনা মোকাবিলার পথ খুঁজতে জেলার জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক ডেকেছিলেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলাশাসক। আলিপুরে জেলাশাসকের কার্যালয়ে আয়োজিত সেই বৈঠকে যোগ দিতে এসেছিলেন ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ অভিষেক।
তিনি সেখান থেকে বেরিয়ে তাঁর ডায়মন্ড হারবার লোকসভার জন্য একগুচ্ছ নির্দেশিকার কথা ঘোষণা করেন। সেখানে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক জানান, আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে লোকসভার অন্তর্গত প্রতিটি পুর ওয়ার্ড ও গ্রাম পঞ্চায়েতে আলাদা করে কন্ট্রোল রুম খোলা হবে।
এমনকি প্রতিটি ওয়ার্ডে পঞ্চায়েত এলাকায় সেফ হোম খোলার চেষ্টা করা হচ্ছে বলেও তিনি জানান। কলকাতা লাগোয়া ডায়মন্ড হারবার লোকসভা কেন্দ্রের বাসিন্দাদের বাইরে বের হতে হলে দুটি করে মাস্ক পড়তে হবে বলেও স্পষ্ট জানিয়েছেন।
আগামী ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত এই নিয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রচার করা হবে। ১৬ জানুয়ারি থেকে ডাবল মাস্ক ছাড়া কেউ বাইরে বের হলে তার বিরুদ্ধে প্রশাসন আইনত কঠোর ব্যবস্থা নেবে বলেও তিনি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
এই সময় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “আমার ব্যক্তিগত মত মানুষের জীবন আগে। তাই আগামী দু’মাস মেলা খেলা রাজনৈতিক সমাবেশ সবকিছু বন্ধ রাখতে হবে।” তাঁর ডায়মন্ড হারবার লোকসভায় সব রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশ এই সময় বন্ধ থাকবে বলে তিনি স্পষ্ট জানিয়েছেন।
এই সময়ই সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে জানান পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন বর্তমান পরিস্থিতি বিচার করে স্থগিত রাখা উচিত ছিল। এই প্রসঙ্গে বাংলার উদাহরণ তুলে ধরে জানান গত বছর আট দফায় বিধানসভা নির্বাচন হওয়ার জন্য রাজ্যে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছিল।
তাঁর আশঙ্কা ভোটমুখী ওই পাঁচ রাজ্যেও একই পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। তিনি সরাসরি না বললেও ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেন বিজেপিকে খুশি করতেই এই পরিস্থিতিতে জাতীয় নির্বাচন কমিশন পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা ভোটের কথা ঘোষণা করেছে।
পাঁচ রাজ্যের ভোট নিয়ে যখন তিনি এই কথা বলছেন, তখনই আশ্চর্যজনকভাবে গঙ্গাসাগর মেলা নিয়ে প্রশ্নের উত্তরে কলকাতা হাইকোর্টকে দেখিয়ে দেন। তাঁর দাবি হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছে বলেই গঙ্গাসাগর মেলা হচ্ছে! অথচ রাজ্য সরকারের পদক্ষেপ ও কলকাতা হাইকোর্টে রাজ্যের আইনজীবীদের বক্তব্য থেকে পরিষ্কার গঙ্গাসাগর মেলা করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল রাজ্য সরকার।
অভিষেক যখন পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা ভোটের বিরোধিতা করছেন সেই সময় রাজ্যের পুরভোট নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তিনি রাজ্য নির্বাচন কমিশনের কোর্টে বলে দেন। অথচ রাজ্য সরকার না চাইলে রাজ্য নির্বাচন কমিশন কোনভাবেই পুরভোট করাতে পারে না।
অর্থাৎ করোনার বাড়বাড়ন্ত সত্ত্বেও সরকার যে রাজ্যে পুরভোট করাতে চাইছে তা স্পষ্ট। এক্ষেত্রে শাসকদল তৃণমূলের মত ছাড়া গোটা বিষয়টি ঘটছে তা বিশ্বাস করা কঠিন। স্বাভাবিকভাবেই এই ঘটনার দায় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘাড়ে এসেও পরে!
একদিকে অভিষেক নিজের সাংসদ এলাকায় করোনা প্রতিরোধে একগুচ্ছ কার্যকরী পদক্ষেপ নিচ্ছেন, সেইসঙ্গে রাখঢাক না করেই তাঁর ব্যক্তিগত মত প্রকাশ্যে তুলে ধরছেন। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা যে কথা বলে আসছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় মূলত সেটাই বলেছেন। বর্তমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর এই অকপট স্বীকারোক্তি নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ।
প্রশ্ন হচ্ছে শুধু মত দিয়ে কী লাভ! তাঁর দলেরই সরকার তো গঙ্গাসাগর মেলা করছে। অথচ বর্তমান পরিস্থিতি বিচার করে এই বছর গঙ্গাসাগর মেলা সহজেই স্থগিত করে দেওয়া যেত। তাতে বিরোধীদলগুলিও খুব একটা কিছু বলত না। যে বিজেপিকে নিয়ে ভয় ছিল তারাও গঙ্গাসাগর মেলা বন্ধের পক্ষেই মত দিয়েছে। তবু কেন গঙ্গাসাগর মেলা হচ্ছে তার উত্তর কী অভিষেক দেবেন?
পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা ভোট নিয়ে জাতীয় নির্বাচন কমিশনকে কাঠগড়ায় তুলেছেন অভিষেক। সত্যিই বর্তমান পরিস্থিতির বিচারে ভোট পিছিয়ে দিলেই ভালো হতো। না হলে এর পরিণাম ভয়াবহ হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কিন্তু অদ্ভুতভাবে রাজ্যের পুর নির্বাচন নিয়ে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক চুপ কেন সেই প্রশ্নও উঠছে।
অভিষেকের যুক্তি মানতে হলে বলতে হয়, রাজ্যের পুর ভোট যদি রাজ্য নির্বাচন কমিশনের বিষয় হয়, তবে পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনও কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের ব্যাপার। সেখানে কেন্দ্রীয় সরকার বা শাসক দল বিজেপির কোনও ভূমিকা নেই!
রাজ্যে হু হু করে সংক্রমণ বাড়ার মাঝেই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে এমপি কাপ ফুটবল টুর্নামেন্টের ফাইনাল অনুষ্ঠিত হয় বাটানগর স্টেডিয়ামে। সেখানে করোনা বিধির বালাই ছিল না বলে অভিযোগ উঠেছে। সব মিলিয়ে আগামী দিনের দিকে তাকিয়ে অভিষেকের একগুচ্ছ ভালো পদক্ষেপের প্রস্তাবের মাঝেই দ্বিচারিতার একটা গন্ধও কিন্তু ছাড়ছে!