ক্ষমতার দম্ভে শ্রদ্ধার ২১ শে জুলাই আজ বিস্মৃতির আড়ালে

পার্থ প্রতীম বিশ্বাস
সম্পাদক, পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি

আজকের প্রজন্মের অনেকেই হয়তো জানেনা যে, একসময়ে আমাদের দেশে ভোটার তালিকায় নাম থাকলেও ছবি বা কোনো পরিচয়পত্র থাকতো না। ফলে এক ব্যাক্তি একাধিক জায়গায় ভোটার তালিকায় তার নাম তুলতেও পারতেন। আর এভাবেই ভোটের কারচুপির শুরু হতো।

যারা বাংলার বাইরে ভোট দেখেছেন তারা জানেন, অন্য রাজ্যগুলোতে ভোট নিয়ে অতটা মাতামাতি না হলেও পশ্চিমবঙ্গে তা হয় মাত্রাতিরিক্ত ভাবেই।

এ বাংলায় দীর্ঘ বাম শাসনের অবসান করতে যা কিছু দরকার ছিলো, তার প্রথম পদক্ষেপ হলো ভোটার তালিকা সংশোধন এবং একাধিক জায়গায় এক ব্যাক্তির নাম বাদ দেওয়া। সেই সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের তরফে ভোটারের ছবি সহ একটি পরিচয়পত্র দেওয়া, যেটা দিয়ে একমাত্র বৈধ ভোটারই ভোট দিতে পারেন।

পশ্চিমবঙ্গে জাতীয় কংগ্রেস দীর্ঘ দিন ধরেই এই নির্বাচনী পরিচয়পত্রের দাবী করে আসছিলো। ১৯৯৩ সালের ২১শে জুলাই ও সেই দাবী নিয়েই তৎকালীন রাজ্য যুব কংগ্রেস সভানেত্রী মমতা ব্যানার্জী পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হেডঅফিস অর্থাৎ ‘রাইটার্স বিল্ডিং’ অভিযানের ডাক দেন।

সেদিনের সেই অভিযানে এ বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে জাতীয় কংগ্রেসের বিভিন্ন শাখা সংগঠন সহ যুব কংগ্রেস কর্মীরাও যোগ দেন। তৎকালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শ্রী জ্যোতি বসুর সরকার সেই অভিযান আটকাতে যথা সম্ভব ব্যাবস্থাও গ্রহণ করে।

কিন্তু কলকাতা উত্তাল করা সেদিনের সেই আন্দোলন রাজ্য সরকারকে এতটাই উত্তেজিত বা ভীত করে তুলেছিলো যে, সরকার আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেয়। নিয়ম অনুযায়ী সরকারের স্বরাষ্ট্র সচিব হিসাবে সেই গুলি চালানোর নির্দেশ যার কলম বা মুখ থেকে প্রকাশ হয় তাঁর নাম শ্রী মনিশ গুপ্ত।

হত্যা করার উদ্দেশ্যে এলোপাথাড়ি চালানো সেই গুলির আঘাতে শহীদ হন জাতীয় কংগ্রেসের ১৩ জন জন বীরসেনানী। কলকাতা শহরের রাস্তা কংগ্রেসীদের রক্তে রাঙা হয়ে ওঠে।

তারপর গঙ্গা দিয়ে বয়ে গেছে গ্যালন গ্যালন জল। ১৯৯৭ সালের ২৭ শে ডিসেম্বর, মমতা ব্যানার্জী জাতীয় কংগ্রেস ছেড়ে নিজের দল অর্থাৎ তৃনমূলের জন্ম দেন। তারপর ২০১১ সালে সেই জাতীয় কংগ্রেসের সাথেই জোট বেঁধেই রাজ্যের ক্ষমতায় আসীন হন।

যদিও ততদিনে ১৯৯৩ সালের সেই কংগ্রেসী মমতা ব্যানার্জী আর নেই। ২০শে মে, মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নিয়েই তিনি নিজের দলের আখের গোছানোর কাজ শুরু করেন। তারই সিদ্ধান্তে ওই বছরের ২১ শে জুলাই শহীদ স্মরণ অনুষ্ঠানটি বদলে যায় বিজয় উৎসবে।

আর এভাবেই বাংলার মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলী মমতা ব্যানার্জীর হাত ধরে এ বাংলার ১৩ জন কংগ্রেসীর রক্তে রাঙানো ২১শে জুলাই দিনটা হয়ে ওঠে বাস্তবে এক পাগলু নাচের আসর।

শুধু কি এইটুকুই? না, এখানেই শেষ নয়। ১৯৯৩ সালের ২১শে জুলাই আন্দোলনের মূল শ্লোগান ছিলো “নো আইকার্ড নো ভোট”। অর্থাৎ নির্বাচন কমিশন ভোটারদের পরিচয়পত্র না দিলে রাজ্যে ভোট করা যাবে না।

SpeakUpAgainstFuelHike : মানুষের সাথে মানুষের পাশে

১৯৯৪ সালেই দেশের তৎকালীন নির্বাচন কমিশনার শ্রী টি এন সেশন এর নেতৃত্বে দেশ জুড়ে সেই আইকার্ড অর্থাৎ নির্বাচনী পরিচয়পত্র তৈরীর কাজ শুরু হয় এবং ১৯৯৫ সাল থেকেই তা ভোটারদের দেওয়া শুরু হয়।

একদিন যে মমতা ব্যানার্জী সকল ভোটারের ভোটদান নিশ্চিত করতে পরিচয়পত্রের দাবীতে সোচ্চার হয়েছিলেন, যে দাবী নিয়ে আন্দোলন করতে গিয়ে এ বাংলার ১৩ জন জাতীয় কংগ্রেস কর্মী আত্মাহুতি দিয়েছেন।

সেই মমতা ব্যানার্জীর সরকারের আমলেই এ বাংলার ভোটার তথা নির্বাচকমণ্ডলী হাতে সেই আইকার্ড থাকা স্বত্তেও নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি।

মমতা সরকারের আমলে ও তত্বাবধানে ২০১৩ ও ২০১৮ সালে এ বাংলায় অনুষ্ঠিত হওয়া পন্চায়েত ভোট এবং বিভিন্ন সময়ে বিশেষত ২০১৫ সালে হওয়া পৌর ভোটে এ বাংলার নাগরিকদের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়েছে মমতা ব্যানার্জীর ছবি ও পতাকা কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো তৃণমূলী জহ্লাদ বাহিনী।

সরকার বিরোধী রাজনীতির ক্ষেত্রে যিনি তার নেতৃত্বের বলিষ্ঠতার কারণে “অগ্নিকন্যা” নামে ভূষিতা হন, সেই তিনিই ক্ষমতায় বসে একসময়ে তার নিজেরই তোলা দাবীকে নস্যাৎ করে দেন। এবং এটা ইতিহাসের এক চরমতম আশ্চর্যের বিষয়।

একদিন যিনি ওই ১৩ জন কংগ্রেসী যোদ্ধার হত্যার তদন্ত ও দোষীদের চরম শাস্তির দাবী করেন, সেই তার শাসনেই ২১শে জুলাই গুলি চালানোর নির্দেশ দেওয়া রাজ্যের তৎকালীন স্বরাষ্ট্র সচিব অবসরের পর তৃণমূলী টিকিটে বিধায়ক, মন্ত্রী ও সাংসদ পদে পুরস্কৃত হন।

২১শে জুলাই ১৯৯৩ যে দলটার জন্মও হয়নি, এমনকি জন্মানোর নুন্যতম আভাসটুকুও ছিলো না। ঘটনার পাঁচ বছর পর জন্ম নেওয়া সেই তৃনমূল দলের নেত্রী যখন ১৯৯৩ সালে শহীদ হওয়া ওই ১৩ জন কংগ্রেসীকে তৃনমূলী বলে দাবী করেন, তখন সুস্থ বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষও তার হুঁশ হারিয়ে ফেলেন।

করোনা ও লকডাউনের কারণে ২১শে জুলাই ২০২০ আবারও মমতা ব্যানার্জী সেদিনের সেই শহীদের স্মরণের নামে তার রাজনৈতিক সভা করবেন। সরকারী ক্ষমতায় থাকায় ডিজিটাল মাধ্যমে সেই সভা পৌঁছেও যাবে রাজ্যের সর্বত্র।

হয়তো ডিম্ভাত খাইয়ে খুশিও করা হবে উপস্থিত জনতাকে। শুধু ওই ১৩ জন শহীদ জানতেও পারবেন না, মমতা ব্যানার্জীর ডাকে ১৯৯৩ সালের ২১শে জুলাই কোলকাতায় হওয়া আন্দোলনে তাঁদের উপস্থিত থাকা ও সেদিনের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর স্বরাষ্ট্র সচিবের নির্দেশে তাঁদের গুলি করে হত্যা করার দায়ে অভিযুক্তরা কেন মমতা ব্যানার্জীর শাসনেই সাজার বদলে পুরস্কৃত হলেন?

ওঁরা জানতে পারবেন না, বুকে কংগ্রেসী রক্ত নিয়ে মৃত্যুবরণ করলেও কোন ম্যাজিকে তাঁরা তাঁদের মৃত্যুর পাঁচ বছর পরে অন্য দলের সম্পত্তি হয়ে গেলেন?

জানতে পারবেন না, তাদের তোলা যে দাবীর জন্য তাঁদের হত্যা করা হয়েছিলো, সেই নির্বাচনী পরিচয়পত্র থাকা স্বত্তেও কেন বাংলার নির্বাচকমণ্ডলী মমতা ব্যানাজীর শাসনেই নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন না?

ক্ষমতায় থাকার কারণে আজ যে মমতা ব্যানার্জী “২১শে জুলাই” দিনটা জাতীয় কংগ্রেসের কাছ থেকে জোর করে ছিনিয়ে নিয়েছেন, ইতিহাসের বিচারে সেই ২১শে জুলাই চিরকালই জাতীয় কংগ্রেসের আন্দোলনের দিন হিসাবেই চিরস্মরণীয় থাকবে।

পরিশেষে সেদিনের সেই শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ও সেই দিনটাকে নিয়ে যেভাবে ছেলেখেলা চলছে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে বলি –

অমর ২১শে

আমার ২১ রক্তে রাঙানো
আন্দোলনের শক্ত ভিত
তোমার ২১ ছেলেখেলা
ছোটোবেলার চু-কিৎকিৎ।
আমার ২১ অধিকারের
মানবধর্ম পুজার ফুল,
তোমার ২১ হরিলুটের
ঠান্ডাঠান্ডা কুলকুল।
আমার ২১ চিরঅমর
সুদুর প্রসারী মানবজমিন,
তোমার ২১ কাগজে মোড়া
লোকদেখানো লজ্জাহীন।
থাকো তুমি তোমার ২১শে
বিকট আওয়াজ আর পাগলুনাচে
আমার ২১ আমারই থাক
মানবতার ছোঁয়ায় বেঁচে।

বিঃদ্রঃ প্রতিবেদনে প্রকাশিত রাজনৈতিক বক্তব্য লেখকের একান্ত ব্যাক্তিগত।

সম্পর্কিত পোস্ট