পুরভোটে তৃণমূলের অন্দরের ক্ষোভ আসলে অর্থের হাতছানি ও বিরোধী দল ভাঙানোর মিলিত পরিণতি!

দ্য কোয়ারি ওয়েবডেস্কঃ কলকাতা পুরসভায় প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পর তৃণমূলের বেশকিছু টিকিট না পাওয়া প্রাক্তন কাউন্সিলর বিক্ষোভ দেখান। চাপে পড়েই শেষ পর্যন্ত কয়েকটি ওয়ার্ডে প্রার্থী বদল করে শাসক দল। তবে বিধাননগর, চন্দননগর, আসানসোল ও শিলিগুড়ি পুর নিগমের প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পর নিচু তলার নেতাকর্মীদের ক্ষোভ যেন সুনামি হয়ে আছড়ে পড়ল।

বিধাননগরের প্রার্থী তালিকা নিয়ে প্রকাশ্যে খুব একটা বিক্ষোভ দেখা যায়নি। কিন্তু বাকি তিনটি পুরনিগমের তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের বিক্ষোভ দেখে প্রশ্ন উঠতেই পারে রাজ্যের শাসকদলে নিয়ম-শৃঙ্খলা বলে আদৌ কী কিছু আছে!

চন্দননগর, আসানসোল এবং শিলিগুড়িতে দায়িত্বপূর্ণ পদে থাকা তৃণমূল নেতারাও প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পর অনুগামীদের নিয়ে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। জাতীয় দল হয়ে ওঠার প্রত্যাশী তৃণমূলের কাছে এটা মোটেও ভালো সঙ্কেত নয়।

প্রশ্ন হচ্ছে কোনও দলই সব টিকিট প্রত্যাশীকে সন্তুষ্ট করতে পারে না। কারণ আসন সংখ্যা সীমিত। সেক্ষেত্রে টিকিট না পেলেই কেন ক্ষুব্ধ হয়ে উঠবেন দলের নেতাকর্মীরা?

চন্দননগর রাজ্যের সেই বিরল পুরনিগম যেখানে নিজেদেরই নির্বাচিত বোর্ড ভেঙে দিয়েছিল তৃণমূল শাসিত রাজ্য সরকার। কারণ মেয়র রাম চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে দলেরই বেশকিছু কাউন্সিলর অনাস্থা আনার তোড়জোড় করছিলেন। তাঁরা সকলেই আবার চন্দননগরের হোমরা-চোমরা তৃণমূল নেতা।

এবারের ঘোষিত প্রার্থী তালিকায় রাম চক্রবর্তী যেমন টিকিট পেয়েছেন, তেমনই তাঁর বিরোধী গোষ্ঠীর নেতাদেরও টিকিট দেওয়া হয়েছে। ফলে চন্দননগরের মানুষের কাছে পরিষ্কার নয় বিগত পুরবোর্ড ভেঙে দেওয়া নিয়ে শাসকদলের প্রকৃত অবস্থান কী!

যদিও সব গোষ্ঠীর নেতাদের টিকিট দিয়েও বিক্ষোভ আটকাতে পারেনি তৃণমূল। প্রাক্তন মেয়রের বিরোধী শিবিরের নেতা অনিমেষ বন্দ্যোপাধ্যায়কে টিকিট দেওয়া হলেও তাঁর স্ত্রী অনন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়কে টিকিট দেওয়া হয়নি। সেই নিয়ে অনিমেষ-অনন্যা অনুগামীরা বিক্ষোভ শুরু করেছে।

পাহাড়ের রাজনীতিতে তৃণমূলের টেক্কা হতে চলেছেন বিনয় তামাং?

কোথাও আবার বিরোধী গোষ্ঠীর নেতাদের কেন টিকিট দেওয়া হয়েছে সেই নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিক্ষোভ হচ্ছে। তৃণমূলের এই অভ্যান্তরীন সমস্যার কারণে হয়রানির মুখে পড়তে হচ্ছে সাধারন মানুষকে। রাস্তা আটকে, টায়ার জ্বালিয়ে শাসক দলের নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন।

ঘটনাচক্রে বিরোধীরাই শুধু নয়, তৃণমূলের অভ্যন্তর থেকেও নানান সময়ে অভিযোগ উঠেছে চন্দননগরে প্রোমোটিংয়ের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে থাকবে তা নিয়েই শাসক দলের মধ্যে মূল বিবাদ। বিভিন্ন শিবিরের নেতারা ইচ্ছেমতো প্রোমোটিং চালাতে গিয়েই একে অপরের সঙ্গে লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েছিলেন।

সেই বিবাদ আজ‌ও বর্তমান। এইরকম গুরুতর অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও অভিযুক্ত নেতাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি শাসক দল। তাদের প্রার্থী তালিকা দেখে প্রশ্ন উঠতেই পারে তবে কী ক্ষমতা দখলই একমাত্র লক্ষ্য তৃণমূলের?

এবার লক্ষ্য দেওয়া যাক শিল্পাঞ্চল আসানসোলের দিকে। সেখানে আবার বিগত পুরবোর্ডের ডেপুটি মেয়র তবসুম আরা সহ চার মেয়র পারিষদ ও একঝাঁক কাউন্সিলরকে টিকিট দেয়নি তৃণমূল। উল্টে কয়েকদিন আগে কংগ্রেস, সিপিএম, বিজেপি থেকে আসা নেতাদের টিকিট দেওয়া হয়েছে।

যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন টিকিট না পাওয়া প্রাক্তন কাউন্সিলর ও নিচু তলার তৃণমূল কর্মীরা। এখানে ক্ষোভের মাত্রা এতটাই বেশি যে টিকিট পাওয়া থেকে বঞ্চিত প্রায় সকলেই নির্দল প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন।

আসানসোল নিয়ে একটা আকর্ষণীয় কথা সব সময় লোক মুখে ঘুরে বেড়ায়, সেখানে নাকি টাকা ওড়ে!

শিল্পাঞ্চল ও কয়লাখনির যুগলবন্দীতে আসানসোলে ঘুরপথে টাকা কামানো খুব একটা আশ্চর্যের বিষয় নয়। বিরোধীদের অভিযোগ গত পাঁচ বছরে কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তি করেছেন প্রত্যেক তৃণমূল কাউন্সিলর। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন হচ্ছে এই বিপুল পরিমান রোজগারের সুযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণেই কী এই প্রবল বিক্ষোভ! কারণ গত পাঁচ বছরের আসানসোলে পুর পরিষেবার বেহালদশা লক্ষ্য করা গিয়েছিল। ফলে সুষ্ঠু নাগরিক পরিষেবা দেবার জন্য এই বিক্ষোভ, এমনটা মনে করার বিশেষ যায়গা নেই।

এবার তাকানো যাক উত্তরবঙ্গের একমাত্র পুরনিগম শিলিগুড়ির দিকে।

২০১১ সালের পর রাজ্যের সর্ব্বত্র আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হলেও শিলিগুড়ির মানুষকে কখনোই পাশে পাননি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পুরসভার ভোট থেকে শুরু করে লোকসভা, বিধানসভা নির্বাচন, সর্বত্রই শিলিগুড়িতে পরাজিত হয়েছে তৃণমূল। এবারে প্রাক্তন মন্ত্রী গৌতম দেবের নেতৃত্বে তারা শিলিগুড়ি দখলের লক্ষ্যে কোমড় বেঁধে নেমেছে।

মজার বিষয় হচ্ছে শিলিগুড়িতে তৃণমূল কখনও না জিতলেও তাদের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব কম নয়। বরং বিরোধীদের অভিযোগ গা জোয়ারি করে হলেও পুরসভা দখল নেওয়া হবে, উপর থেকে এরকম বার্তা পেয়েই নির্বাচনে টিকিট পাওয়ার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছে সেখানকার তৃণমূল নেতারা।

আর এখানেই শুরু হয়েছে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। এমনিতেই সিপিএম ও বিজেপি থেকে এক ঝাঁক নেতারা তাদের দলে যোগ দেওয়ায় টিকিট প্রত্যাশীদের সংখ্যা আরও বেড়েছে। এই পরিস্থিতিতে ৪৭ আসনের শিলিগুড়ি পুরসভার প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পরই বিক্ষোভ শুরু হয়েছে।

ঘটনা হচ্ছে সাংসদ, বিধায়ক হলে ন্যায্য পথে একজনের যতটা অর্থপ্রাপ্তি হয় পুরসভার কাউন্সিলর হয়ে তার ধারে কাছে কিছুই হয় না। এখনও পর্যন্ত রাজ্যে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা প্রতি মাসে ভাতা পান একজন কাউন্সিলর।

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, কাউন্সিলর থাকার জন্য কেন শাসক দলের মধ্যে এত তীব্র প্রতিযোগিতা?

গত এক দশক জুড়ে দেখা গিয়েছে বিভিন্ন জায়গায় কাউন্সিলরদের উদ্যোগেই প্রোমোটিং রাজ চলছে। এক্ষেত্রে বিরোধীদের অভিযোগ বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। তাদের দাবি তৃণমূল কাউন্সিলর হওয়া মানেই বিভিন্ন ব্যবসায়ী, কল-কারখানা, প্রোমোটারদের কাছে থেকে নির্দিষ্ট মাসিক মাসোহারা পাওয়া যায়। বিনিময়ে সেই ব্যবসায়ীরা আইন না মেনে নিজেদের কাজ চালিয়ে যাওয়ার ছাড়পত্র পান! অনেক জায়গায় বেনামে কাউন্সিলররাই প্রোমোটিং করেন।

এই পরিস্থিতিতে কাউন্সিলর হতে না পারলে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জনের সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায়। কারণ নতুন যিনি কাউন্সিলর হবেন তিনি তাঁর মতো করে গোটা বিষয়টি চালাবেন। তার উপর তৃণমূলে সাংসদ, বিধায়ক, পঞ্চায়েতের সদস্য এবং কাউন্সিলর এই তিনটির কোন‌ও একটি পদে না থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ প্রায় শেষ হয়ে যায়। এক্ষেত্রে দলের মূল ‘সার্কিটে’ টিকে থাকাটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

পুরভোটের টিকিট নিয়ে শাসক দলের অন্দরে এত বিক্ষোভের আরেকটি কারণকে চিহ্নিত করা যায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় মুখে না বললেও আসলে বিরোধীশূন্য রাজনীতি করতে চান। তাই লাগাতার তাঁরা বিরোধী দল ভাঙান।

এক্ষেত্রে বিরোধী দল থেকে যে নেতারা আসেন তাঁরা পুরভোটের টিকিটের অন্যতম দাবিদার থাকেন। তাঁদের অনেককেই প্রার্থীও করেছে দল। স্বাভাবিকভাবেই আসন সংখ্যা নির্দিষ্ট থাকায় অনেক পুরনো নেতা বাদ পড়েছেন।

বিশেষ করে যারা গত দু’দশক ধরে দলটিকে একটু একটু করে গড়ে তুলেছেন তাঁরা দলে আসার নতুনদের টিকেট দেওয়ার বিষয়টি মানতে পারছেন না। সবমিলিয়ে কোন‌ও একটি নির্দিষ্ট কারণ নয়, বরং একাধিক কারণের মিলিত ফল হল পুরভোটের টিকেট নিয়ে তৃণমূলের অন্দরের এই তীব্র ক্ষোভ। বিশেষত তারা বাংলায় একচ্ছত্র আধিপত্য ধরে রাখায় সকলেই এই সুযোগে পুর প্রতিনিধি হতে চাইছেন।

আর বিধাননগরে প্রার্থীপদ নিয়ে প্রকাশ্যে খুব একটা বিক্ষোভ না হলেও একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তৃণমূল কর্মীদের মধ্যে ভেসে বেড়াচ্ছে। মাত্র সাত-আট মাস আগেও যে সব্যসাচী দত্ত উঠতে-বসতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তৃণমূলকে তুলধনা করেছেন সেই তাঁকেই সসম্মানে টিকিট দিল দল! তবে কী নিষ্ঠাভরে দল করার কোনও মূল্য নেই তৃণমূলে? সবটাই ক্ষমতা ও অর্থের মেলবন্ধন? আগামী দিনে এই তেতো প্রশ্নের জবাব দিতেই হবে মমতা-অভিষেককে!

সম্পর্কিত পোস্ট