নিজেদের মমতার থেকে বেশি জনপ্রিয় প্রমাণের তাগিদ ! পুরভোটে গাজোয়ারি তৃণমূলের একাংশের!
দ্য কোয়ারি ওয়েবডেস্কঃ একুশের বিধানসভা নির্বাচনেই বোঝা গিয়েছিল বাংলার মানুষের হৃদয়ের ঠিক কতটা গভীরে আছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার পরবর্তী পর্যায়ে বিধানসভা উপনির্বাচন, কলকাতা পুরভোট এবং সম্প্রতি রাজ্যের চার পুরনিগমের ভোটে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে বাংলায় তৃণমূলের ভিত কতটা গভীর। এখন পরিস্থিতি এমনই যে কে বিরোধী সেটাই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না! তবুও এই চার পুরনিগমের ভোটের ফল কিছু অপ্রিয় বিষয় সামনে নিয়ে এসেছেন।
একমাত্র শিলিগুড়ি বাদে বাকি তিনটি পুরনিগম অর্থাৎ বিধাননগর, চন্দননগর ও আসানসোলে তৃণমূলই যে ক্ষমতা দখল করবে সেটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এই তিন জায়গার ভোটে অনিয়ম বা গাজোয়ারির কোনও প্রয়োজনই ছিল না। তবু ১২ ফেব্রুয়ারি ভোটের দিন বিক্ষিপ্তভাবে বেশকিছু ঘটনা ঘটে। এটা ঠিক ভোটের দিন খুব বড় কোনও অশান্তি না হলেও ছোট ছোট অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে।
১৪ ফেব্রুয়ারি ভোটের ফল বের হতে দেখা গেল প্রয়োজন ছাড়াই গুরুতর গোলযোগ ঘটে গিয়েছে বিধাননগর ও আসানসোলে। বিশেষ করে বিধাননগরে গোলযোগের মাত্রা দৃষ্টিকটুভাবে অত্যন্ত বেশি।
অথচ যে শিলিগুড়িতে মনে করা হয়েছিল তৃণমূল পিছিয়ে আছে সেখানেই কোনও অশান্তি হয়নি। চন্দননগরেও সেভাবে কোনও অনিয়ম ঘটেনি। কিন্তু শিলিগুড়িতে সকলকে চমকে দিয়ে ৪৭ এর মধ্যে ৩৭ টি ওয়ার্ডের জিতে প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় এসেছে তারা। অর্থাৎ শান্তিপূর্ণভাবে ভোট হলে মানুষ তৃণমুলকেই আপন করে নিচ্ছে।
এদিকে আসানসোলে ১০৬ টি ওয়ার্ডের মধ্যেই ৯১ টি তেই জয়ী হয়েছে তৃণমূল। এখানে ভোটের দিনে জামুরিয়া, রানিগঞ্জ এলাকায় বেশ কিছু অশান্তির খবর নজরে এসেছিল। ভোট গণনার আগের রাতে ধাদকা পলিটেকনিকের স্ট্রং রুমের সিসিটিভি হঠাৎই ঘন্টাখানেকের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। তা নিয়েও বিতর্ক দেখা দেয়।
পরে ভোটের ফল বেরোলে দেখা যায় কিছু ওয়ার্ডে বিরোধীরা একেবারে কানে ঘেঁসে হেরে গেলেও বেশ কিছু ওয়ার্ড আছে যেখানে অস্বাভাবিক হারে ভোট পেয়েছে তৃণমূল প্রার্থীরা। কিন্তু আসানসোলে বিজেপির সেই মাঝের সময়ের দাপট নেই।
তাই এই অস্বাভাবিক হারে ভোট না পেলেও চলত শাসকদলের। তাতে ৯১ এর জায়গায় হয়তো ৮০ টি ওয়ার্ডে জিততেন তৃণমূল প্রার্থীরা, কিন্তু পুরসভা তাদেরই দখলেই আসত।
তবে সবচেয়ে মারাত্মক ছবিটা ধরা পড়েছে বিধাননগরে। ভোটের দিন সবচেয়ে বেশি অশান্তি হয়েছিল কলকাতার এই পার্শ্ববর্তী কেন্দ্রে। বিশেষ করে বিধাননগর পুরসভার অন্তর্গত রাজারহাট এলাকায় অশান্তি সবচেয়ে বেশি ছিল।
অথচ অতীতের বিভিন্ন ভোট সমীকরণ বলছে বিধাননগর পুর এলাকার রাজারহাট, লেক টাউন এলাকায় তৃণমূলের দাপট নিয়ে কোনও সংশয় ছিল না। ওখানকার মানুষ এমনিতেই তাদের ভোট দিতেন। বরং সল্টলেক এলাকায় একটু হলেও চিন্তা ছিল শাসকদলের।
ভোটের ফল প্রকাশের পর দেখা যায় রাজারহাট এলাকার বিভিন্ন ওয়ার্ডে ৮০ শতাংশের ওপর ভোট পেয়েছেন তৃণমূল প্রার্থীরা। বিধাননগর পুরসভার মোট ১৭ টি ওয়ার্ডে এই অস্বাভাবিক হারে ভোট পেয়েছে শাসক দল। এর মধ্যে তিনজন প্রার্থী ৯০ শতাংশের ওপর এবং ২ জন প্রার্থী ৯৪ শতাংশের উপর ভোট পেয়েছেন।
এই তালিকায় আছেন বিধাননগরের প্রাক্তন ডেপুটি মেয়র তথা তৃণমূল বিধায়ক তাপস চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে আরাত্রিকা ভট্টাচার্য। এবারই প্রথম প্রার্থী হয়ে তিনি প্রায় ৯৫ শতাংশ ভোট পেয়েছেন।
বিরোধীদের অভিযোগ, সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ভোট হলে কেউ ৯০-৯৫ শতাংশ ভোট পেতে পারে না। তাদের দাবি, এই ভোট শতাংশের তথ্যগুলোই বলে দিচ্ছে পুরভোটে বিধাননগর জুড়ে ভোটের নামে লুট হয়েছে!
স্থানীয় স্তরের নির্বাচনে গাজোয়াড়ি করলে বড় যায়গায় ভালোর বদলে ক্ষতিই যে বেশি হয় তা অতীতে প্রমান হয়ে গিয়েছে। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতেই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতা পুরনির্বাচনের আগে থেকে বারবার বলেছেন, প্রত্যেক প্রার্থীকে নিজের যোগ্যতায় ভোটে লড়তে হবে।
দল সাংগঠনিকভাবে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করবে, কিন্তু ভোটে কোনরকম অনিয়ম বা জোরজবরদস্তি মেনে নেওয়া হবে না। কলকাতার ভোটে ৬৬ নম্বর ওয়ার্ড সহ কিছু জায়গায় গাজোয়ারি হলেও সার্বিকভাবে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথেই চলেছিল দল। তাই বিরোধীরা কলকাতায় তৃণমূলের জয়কে কালিমালিপ্ত করতে পারেনি।
কিন্তু তৃণমূলের নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিদের সুচিন্তিত ভাবনা উপেক্ষা করেই পুরভোটে বিধাননগর ও আসানসোলে গাজোয়ারি চলে। তারই প্রতিফলন ঘটে যুব তৃনমূলের শীর্ষস্থানীয় নেতা দেবাংশু ভট্টাচার্যের সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে। এই তরুণ নেতা প্রকাশ্যেই সাবধান করে দেন, স্থানীয় স্তরের নির্বাচনে গাজোয়ারি হলে তার প্রভাব ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনে পড়তে পারে, ঠিক যেমনটা হয়েছিল ২০১৯ এর লোকসভা ভোটে।
প্রশ্ন হচ্ছে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়রা সুস্থ পথে নির্বাচনের কথা বলছেন। তবু পুরভোট, পঞ্চায়েত ভোটে কেন এমন অনিয়মের ঘটনা ঘটছে? এক্ষেত্রে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার বাসনা নিয়ে চলা তৃণমূলের একশ্রেণীর পুরনো নেতার দিকে অভিযোগের আঙুল উঠতে পারে। সম্ভবত তাঁরা দলের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হাতে ক্ষমতা হারানোর ভয় পাচ্ছেন। সেই কারণেই গাজোয়ারি করে বিরোধীদের সামান্য ভোটটুকুও কেড়ে নিয়ে নিজেদেরকে অতি জনপ্রিয় দেখানোর বাসনায় মেতে উঠছেন।
কি হতো যদি রাজারহাট এলাকায় তৃণমূল প্রার্থীরা নিজেদের ভোট ওইভাবে করিয়ে না নিতেন? হিসেব বলছে তাতে শাসক তৃণমূলের ভোট শতাংশ কিছুটা কমলেও আসনসংখ্যায় বিশেষ হেরফের হতো না। কারণ রাজারহাট এলাকার ওয়ার্ডগুলোতে বিরোধীদের জেতার মতো পরিস্থিতি এমনিতেই ছিল না!
Bappi Lahiri Passes Away : প্রয়াত কিংবদন্তী সঙ্গীতশিল্পী বাপ্পি লাহিড়ি, শোকের ছায়া শিল্পীমহলে
আর এখানেই হয়ে গেছে মুশকিল। জনগণের ৬০ শতাংশ ভোট নিয়ে মন ভরছে না ক্ষমতালোভী মুষ্টিমেয় কয়েকজনের। তাদের ৮০-৯০ শতাংশ ভোটই চাই। তারা নিজেদেরকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের থেকেও বেশি জনপ্রিয় প্রমাণ করতে চান। যার কারণেই দুর্নাম ভোগ করতে হচ্ছে বাংলার শাসক দলকে।
এই অবস্থায় কড়া হাতে পরিস্থিতি সামলাতে হবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। প্রয়োজনে এই ক্যান্সারদের দেহ থেকে ছেঁটে ফেলার সময় এসে গিয়েছে। না হলে ভবিষ্যতে বড় বিপদে পড়তে পারে তাঁর দল। কারণ ক্যান্সার সারা দেহে ছড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতি সামলানো সত্যিই কঠিন!
তাছাড়া সুষ্ঠু গণতন্ত্রের জন্য বিরোধীদের অস্তিত্ব অত্যন্ত প্রয়োজন। বাংলার বেশিরভাগ মানুষ যেমন তৃণমূলকে আপন করে নিয়েছে তেমনই স্বাভাবিক নিয়ম মেনে বিরোধীদের অস্তিত্বও আছে। কিন্তু সব ভোট আমি পাব, এই মনোভাব নিয়ে চললে বিরোধী স্বর শোনা যাবে না। তার ফলে শাসক দল নিজেদের খামতি, ব্যর্থতার কথা সময়মতো জানতে পারবে না। তাতে ভবিষ্যতে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে!