সঙ্কটে রাজনীতি, হারাচ্ছে সৌজন্যতা, চলছে কদর্য ভাষায় প্রতিপক্ষকে আক্রমণ

।। দিলীপ রায়।। 

ভারতীয় গণতন্ত্রে রাজনীতি এক গভীর সঙ্কটের মুখে পড়েছে। সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার ন্যূনতম প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণের দাবি রাজনীতির পরিসরে ক্রমশ উপেক্ষিত হচ্ছে। সবার জন্য খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সংসদীয় গণতন্ত্রে আলোচনার সুযোগ ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে আসছে।এর বিপরীতে রাজনীতিতে শুরু হয়েছে কদর্য ভাষার নির্বিচার প্রয়োগ। দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে রাজনীতি। জনমুখি এজেন্ডা না থাকার ফলে প্রতিপক্ষকে আক্রমণের সময় হামেশাই অশ্লীল, অশালীন শব্দের অহরহ প্রয়োগ করে চলেছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতানেত্রীরা।

আরও পড়ুনঃ তৃণমূলের সম্প্রীতির পোস্টার ঘিরে বিতর্কিত মন্তব্য বাবুলের, পাল্টা জবাব পার্থর

রাজনৈতিক দলের নেতানেত্রীদের এইসব কদর্য ভাষা বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ না খেলেও তাঁরা এর ব্যবহার করে চলেছেন। এ রাজ্যে যুক্তফ্রন্ট আমলে নকশাল আন্দোলনের বিরোধিতায় কদর্য ভাষার প্রথম প্রয়োগ সম্ভবত করেছিলেন সিপিএম নেতা প্রমোদ দাশগুপ্ত। তিনি বলেছিলেন, নকশালরা মারা যাচ্ছে না কেন? পুলিশের বন্দুকে কি নিরোধ লাগানো আছে? সেই শুরু। এরপরে ৭৭ সালের পর ক্ষমতাসীন বামফ্রন্ট নেতাদের কারও কারও মুখে প্রতিপক্ষকে নিম্নমানের ভাষায় আক্রমণ করতে দেখা গিয়েছে। তবে সব কিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন সিপিএম নেতা বিনয় কোঙার।

নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সমর্থনে মেধা পাটেকরের সেখানে জনসভা করতে যাওয়ার খবরে তিনি বলেছিলেন, নন্দীগ্রামের মেয়েরা মেধা পাটেকরকে ‘পাছা’ দেখাবে। নন্দীগ্রাম আন্দোলনকারীদের ঘিরে ফেলে ‘লাইফ হেল করে দেব’ হুমকিও দিয়েছিলেন এক সিপিএম নেতা।ধর্ষণের অভিযোগ উঠলে তাঁর চরিত্র নিয়ে প্রশ্নও তুলেছিলেন বাম নেতারা। বাম মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু গণআন্দোলনে পুলিশের গুলি চালানোর পক্ষে সাফাই দিয়ে বলেছিলেন, ইটপাটকেল মারলে পুলিশ কি রসগোল্লা ছুড়বে? বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিভিন্ন সময়ে বাম নেতানেত্রীরা কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ করেছেন, ‘বস্তির মেয়ে’, ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’ সহ নানাকিছু বলেছেন। ২০১১ সালে বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ঘুরিয়ে ‘সেক্স ওয়ার্কার’ বলে কটাক্ষ করেছিলেন সিপিএম নেতা অনিল বসু।

রাজ্যে পালাবদলের পরও বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কদর্য ভাষার প্রয়োগ আরও বেড়ে গিয়েছে।অন্যদিকে, রাজনীতিতে কমেছে আলোচনার পরিসর। গালি দেওয়া হাল আমলের রাজনীতির একটা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছেও বলা যায়। যার ফলে সাম্প্রতিক অতীতে কৃষ্ণনগরের তৎকালীন তৃণমূল সাংসদ অভিনেতা তাপস পাল প্রতিপক্ষ দলের কর্মীসমর্থকদের বাড়ি ঢুকে তাদের মা-বোনদের রেপ করার হুমকি দেন। রাজনীতির অঙ্গনে আকথা কুকথায় যদিও সবার থেকে এগিয়ে রয়েছে বিজেপি।

সারা দেশের পাশাপাশি বাংলাতেও কুকথা বলাতে সেরার শিরোপা পেয়েছেন বিজেপি্র নেতানেত্রীরা। এরাজ্যে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের শুরুতে ট্রেন-বাস ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, স্টেশন ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এরপর বিজেপি রাজ্য সভাপতি, সাংসদ দিলীপ ঘোষ এক প্রকাশ্য সভায় প্রতিবাদীদের গুলি করে মারার নিদান দেন।শুধু তাই নয়, তিনি বলেন, এখানে আসবে, আমাদের খাবে-দাবে, সম্পত্তি নষ্ট করবে। জমিদারি পেয়েছে নাকি। লাঠি মারব, গুলিও করব, জেলে ঢুকিয়ে রাখব। অন্য এক সভায় দিলীপ ঘোষ তৃণমূল কর্মীসমর্থকদের হুমকি দিয়ে বলেন, “আমাদের আঘাত করলে সোজাসুজি এনকাউন্টার করে দেব।কুকুরের মতো গুলি করে মারব”।লোকসভা নির্বাচনের সময় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বিভিন্ন জনসভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ‘তুই তোকারি’ করে সম্বোধন করেছেন।

আরও পড়ুনঃ ৩০ ঘন্টা পরেও কাটছে না বিপদ, ভেন্টিলেশনে দুই পড়ুয়া

বাম আমল থেকে বর্তমান সময়, বুদ্ধিজীবীরা যে দলের বিরুদ্ধে গিয়ে ন্যায়ের কথা বলেছেন, সে দলই তাদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছে। নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনও বাম আমলে সিপিএমের বা এখন কেন্দ্রের শাসকদলের আক্রমণ থেকে ছাড় পাননি। সদ্য নোবেলজয়ী অভিজিত বিনায়ক সম্পর্কেও কুকথা বলেছেন দিলীপ ঘোষ। তাঁর দাবি, অভিজিত বিনায়ক বিদেশী বিয়ে করেছেন বলেই নোবেল পেয়েছেন। সিএএ, এনপিআর, এনআরসি বিরোধী পার্কসার্কাসের প্রতিবাদীদের অশিক্ষিত বলে উল্লেখ করেছেন দিলীপ ঘোষ।তাঁর দাবি, বিরিয়ানি খাওয়ার লোভে সেখানকার মহিলারা আন্দোলন করছেন।

আকথা কুকথা থেকে বিধানসভাও মুক্ত নয়।শনিবার রাজ্য বিধানসভায় বাজেট বক্তৃতার সময়ে মেমারির তৃণমূল বিধায়ক নার্গিস বেগম সিপিএম বিধায়ক জাহানারা খানকে কটাক্ষ করে বলেন, এবার আপনাকে ধর্ষণ করা হবে।যদিও পরে ক্ষমা প্রার্থনা করেন তিনি।সবার শেষে উল্লেখ করতে হয় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়র টুইট। একসময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাটআউটের পাশে লেখা থাকত সততার প্রতীক। এখন লেখা থেকে সম্প্রীতির প্রতীক।

 

এটাকে কটাক্ষ করে বাবুল সুপ্রিয় টুইটারে লিখেছেন, পশ্চিবঙ্গের সব থেকে উল্লেখযোগ্য ‘পরিবর্তন’।‘সততার প্রতিক’ থেকে ‘সম্প্রীতির প্রতীক’।আর দিদির সম্প্রীতি মানে আসলে কি, মানুষ খুব ভালো করেই জানে। প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করতে গিয়ে ভাষা চুলোয় গেলেও কিছু এসে যায় না রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের। বাবুল সুপ্রিয়রও কিছু এসে যায় না। ফলে অনায়াসে তিনি টুইটারে পশ্চিমবঙ্গকে ‘পশ্চিবঙ্গ’ বা প্রতীককে ‘প্রতিক’ লিখতে পারেন এবং বাংলার সংস্কৃতি রক্ষায় গলাও ফাটাতে পারেন।কিন্তু তাতে রাজনীতির সংকট আরও বাড়বে, আরও বিপন্ন হবে সাধারণ মানুষ।

সম্পর্কিত পোস্ট