করোনাকে বাড়তে দিয়ে এখন কড়াকড়ি, আমজনতাকে ভাতে মারার ব্যবস্থা করল সরকার!
গতবছর বিধানসভা নির্বাচনের সময় রাজ্যে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়েছিল। প্রায় দু’মাস প্রবল আতঙ্কের মধ্যে কাটানোর পর ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। সেই সময়ই চিকিৎসকরা তৃতীয় ঢেউয়ের আগমনবার্তা দিয়েছিলেন। প্রথমে মনে করা হয়েছিল অক্টোবর মাস নাগাদ পশ্চিমবঙ্গ সহ গোটা দেশে এই মারণ ভাইরাসের তৃতীয় ঢেউ আছড়ে পড়বে।
কিন্তু দেখা যায় পশ্চিমবঙ্গে দুর্গাপুজো কেটে গেলেও তৃতীয় ঢেউ সেভাবে আসেনি। সারাদেশেই অক্টোবর মাসে সংক্রমণ সামান্য বৃদ্ধি পেলেও দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ফলে চিকিৎসকদের পাশাপাশি আমজনতাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। আর সেটাই যেন কাল হয়েছিল! তারপরই আরও বেশি করে লাগামছাড়া হয়ে ওঠে মানুষ।
এরইমধ্যে মারাত্মক সংক্রামক ওমিক্রণ স্ট্রেন দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ভারতও স্বাভাবিকভাবেই সেই তালিকা থেকে বাদ পড়েনি। পশ্চিমবঙ্গেও ওমিক্রণ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। তবে রাজ্যে এখনও পর্যন্ত প্রভাবশালী কারোনা ভ্যারিয়েন্ট হিসেবে ডেল্টা কাজ করছে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।
বছরের শেষে জনসাধারণের একটা বড় অংশের লাগামছাড়া মনোভাব এবং সরকারের অবাক করা নিষ্ক্রিয়তার পরিণাম মাত্র ১৮ দিনে রাজ্যে ১০ গুণেরও বেশি সংক্রমণ বৃদ্ধি। কলকাতায় পজিটিভিটি রেট এই মুহূর্তে প্রায় ৩৩%। রাজ্যেও পজিটিভিটি রেট ১৫% ছুঁইছুঁই অবস্থায়।
করোনার যে দ্বিতীয় ঢেউয়ে হাহাকার পড়ে গিয়েছিল গোটা রাজ্য জুড়ে, তখনও পজিটিভিটি রেট এই ভয়াবহ জায়গায় গিয়ে পৌঁছয়নি। হ্যাঁ, এখনও সংক্রমনের এই ভয়াবহ বৃদ্ধির কারণে হাসপাতালগুলি রোগীতে উপচে পড়ছে না। কারণ বেশিরভাগ আক্রান্ত হয় উপসর্গহীন, না হলে তাঁদের হালকা সর্দি-কাশির মতো মৃদু উপসর্গ আছে।
কিন্তু আগামী কয়েক দিনের মধ্যে তারা কেউ অতিরিক্ত অসুস্থ হয়ে পড়বেন না, বা আগামীদিনে আর যারা আক্রান্ত হবেন তাদের শারীরিক পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠবে না এ কথা হলফ করে বলা যায় না। অন্তত মাসখানেক না গেলে নিশ্চিত করে কিছুই বলা সম্ভব নয়, যে মানুষ আক্রান্ত হলেও বিপদের কিছু নেই!
সেক্ষেত্রে আগাম সতর্ক থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। চিকিৎসাশাস্ত্রের নিয়ম অনুযায়ী আপনার বিপদ ঘটবে না এইরকম ব্যবস্থা আগে থেকে করাটা জরুরী। কিন্তু রবিবার দুপুরে নবান্নের একগুচ্ছ নির্দেশিকা সামনে আসার পর বোঝা গেল সরকারের অবস্থা চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ের মতো! তারা প্রথমে চোরকে চুরি করার উৎসাহ দিলেন, তারপর গেরস্থকে দায়ী করছেন তোমরা কেন সাবধান হওনি!
বড়দিনের উৎসব থেকে শুরু করে নতুন ইংরেজী বছরের প্রথম দিন, এই গোটা উৎসবের মরসুমে জনগণের উপর এতোটুকু লাগাম টানার চেষ্টা করেনি রাজ্য সরকার। এর ঠিক আগেই যাবতীয় স্বাস্থ্যবিধি লাটে তুলে কলকাতা পুরসভার ভোট হয়।
সেখানে বিরোধীদের পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রী নিজে বড় জমায়েত করে জনসভা করেছিলেন। আর সংক্রমণ ভয়াবহ জায়গায় পৌঁছে যেতেই প্রথম কোপটাই পড়ল লোকাল ট্রেনের উপর। নবান্নের নির্দেশ সন্ধে ৭ টার পর লোকাল ট্রেন চালানো যাবে না।
ইতিমধ্যেই দক্ষিণ-পূর্ব রেলের পক্ষ থেকে নির্দেশিকা জারি করে বলে দেওয়া হয়েছে, যে সমস্ত ট্রেন সন্ধে ৭ টার মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছে যাবে সেগুলিই কেবল চালানো হবে। পূর্ব রেল এখনও কোনও কিছু নির্দিষ্ট করে না জানালেও তারা যে সেই পথেই হাঁটবে তা সহজেই অনুমেয়।
এবার একটা সহজ পরিসংখ্যানে আসা যাক। শিয়ালদহ থেকে কাকদ্বীপ-নামখানায় পৌঁছতে সময় লাগে আড়াই থেকে তিন ঘন্টা। অর্থাৎ নবান্নের নির্দেশিকার পরিপ্রেক্ষিতে বিকেল ৪ টের আগে কাকদ্বীপ-নামখানার শেষ ট্রেন ছেড়ে যাবে! ক্যানিং-ডায়মন্ড হারবারের ক্ষেত্রেও বিকেল ৫ টার আগেই শেষ লোকাল ট্রেন ছাড়বে শিয়ালদহ থেকে।
একই কথা প্রযোজ্য বসিরহাট, বনগাঁ, গেদে লোকালগুলির ক্ষেত্রে। হাওড়া থেকে বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, হুগলির যে প্রান্তিক লোকাল ট্রেন ছাড়ে বা মেদিনীপুর-ঝাড়গ্রাম-পুরুলিয়া জেলার যে ট্রেনগুলি আছে সেগুলির কোনওটা দুপুর সাড়ে তিনটের আগেই শেষ বারের মতো হাওড়া স্টেশন থেকে ছাড়বে!
আচ্ছা বলুন তো কোন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা কারখানা দুপুর তিনটেয় তার কর্মীদের ছুটি দিয়ে দেয়? বাস্তবে এটা সম্ভব নয়। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে রাজ্যের দূরদূরান্ত থেকে যে সমস্ত মানুষ কলকাতা ও শহরতলীতে কাজে আসেন তাঁদের রুটিরুজিতে আবার কোপ পড়ল।
অনেক বেসরকারি সংস্থা তার কর্মীদের ওয়ার্ক ফ্রম হোম করতে দেবে। কিন্তু সেটা হাতে গোনা কয়েকটা জায়গায় মাত্র। যে প্রান্তিক মানুষটি শহরে এসে লোকের বাড়িতে ঠিকে ঝিয়ের কাজ করেন, বা যিনি আয়ার কাজ করেন অথবা যিনি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থায় সারাদিন পরিশ্রম করে সামান্য দুটো টাকা সংসার চালানোর জন্য ঘরে নিয়ে যান তাঁদের কি হবে?
সরকার নিয়ম করেছে রাত ১০ টা থেকে পরের দিন ভোর ৫ টা পর্যন্ত নাইট কারফিউ জারি থাকবে। এর জন্য রাত ১০ টা পর্যন্তই রেস্তোরাঁ-বারগুলি খোলা থাকবে। এই রেস্তোরাঁ বা বারগুলির চাকচিক্যের আড়ালে অজস্র মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সামান্য দুটো টাকা রোজগার করা মানুষের গল্প লুকিয়ে থাকে। তারা কেউ ওয়েটার কেউ বা সাফাই কর্মী হিসেবে কাজ করেন।
সেই তাঁদের পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠল এই সরকারি বিধি নিষেধের কারণে। এবার বিষয় হচ্ছে সরকারের অনুমতি থাকায় হলফ করে বলা যায় রেস্তোরাঁ ও বার মালিকরা ব্যবসার স্বার্থে রাত ১০ টা পর্যন্ত তাদের প্রতিষ্ঠান খুলে রাখতে চাইবেন। সেক্ষেত্রে এই অসহায় কর্মীরা কী করে বাড়ি ফিরবেন?
ধর্ম নামক বাঘের পিঠে চড়ে বসেছেন মমতা! তাই গঙ্গাসাগর মেলা বন্ধ করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব
স্বাভাবিকভাবেই সরকারের এই তুঘলকি নিষেধাজ্ঞার পর প্রশ্ন উঠেছে গোটা বিষয়টা কী অন্যভাবে সামলানো যেত না? ট্রেনের সংখ্যা না কমিয়ে রেল দফতরের সঙ্গে কথা বলে আরও বেশি করে কী ট্রেন চালানো যেত না? তাহলে ভিড় অনেকটা কম হতো।
যারা পেটের তাগিদে কাজে বের হন শুধু তাঁদের যাতায়াতের উপর ছাড়পত্র দিয়ে, মনের আমোদে ঘুরতে বেরনো বা খেজুরে কারণে যারা ট্রেন-বাসে চাপেন তাঁদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারির কোনও ব্যবস্থা কী করা যেত না? তাহলেও তো ভিড় অনেকটাই কম হতো। কিন্তু সরকার বিকল্প পথের কথা ভাবলই না!
এই নাইট কারফিউয়ের জেরে হাজার হাজার সব্জি বিক্রেতার যে কতটা ক্ষতি হল সেটা কী সরকারের নীতি নির্ধারকেরা জানেন? তাঁরা এবার যাবেন কোথায়!
এমনিতেই ২০২০ সালে শুরু হওয়া করোনার তাণ্ডবে গত দু’বছরে শুধু যে দেশের অর্থনীতি ধসে গিয়েছে তা নয়, অসংখ্য সাধারণ মানুষ কাজ হারিয়েছেন। তারা ধীরে ধীরে একটু একটু করে হয়তো সামলে নিচ্ছিলেন বা কেউ হয়তো সামলে উঠতে না পারলেও আগামীদিনে সামলে নেবেন এই আশা রেখে চলছিলেন। কিন্তু এই নতুন কড়াকড়ি সবটাই অনিশ্চয়তার মুখে ফেলে দিল। হয়তোবা কফিনে শেষ পেরেকটাই পুঁতে দিল!
আপাতত ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সরকার বাহাদুর এই বিধি-নিষেধ জারি করেছে। কিন্তু যা পরিস্থিতি এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন এবং আমজনতার যা অতীত অভিজ্ঞতা তাতে প্রায় নিশ্চিত করে বলা যায় অবধারিতভাবে এই নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ আরও বাড়বে।
এদিকে কেন্দ্রীয় সরকার রেশনের মাধ্যমে যেটুকু বিনামূল্যে খাদ্যশস্য দিচ্ছিল তাও বন্ধ হয়েছে। রাজ্যও অতিরিক্ত আর কোনও দায়িত্ব নিচ্ছে না। অসংখ্য সাধারণ মানুষ বিভিন্ন ক্ষুদ্র লোন প্রদানকারী সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে থাকেন ব্যবসার কাজে।
কিন্তু সেই ঋণ শোধেও আর কোনও ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। এই নতুন নিষেধাজ্ঞা জেরে যখন মানুষের আয় আবার বন্ধ হওয়ার মুখে, তখন তাঁরা খাবেই বা কী আর ঋণ শোধই বা করবে কি করে? দেখা যাচ্ছে এগুলো ভাববার কেউ নেই!
সরকারের কাণ্ডজ্ঞানহীন মনোভাব ও অবিবেচক নীতি আমজনতাকে পুরোপুরিভাবে অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখে ফেলে দিল। করোনায় না মরলেও অভাব ও দারিদ্র্যে তার আর বোধহয় রেহাই নেই!