গণতন্ত্রের উৎসবে করোনার দাপাদাপি, দেরি হয়ে যাচ্ছে না তো?

সহেলী চক্রবর্তী

তাপমাত্রার পারদ চড় চড়িয়ে বাড়ছে। গনগনে আঁচে টগবগিয়ে ফুটছে নির্বাচনী প্রচার। তারই মাঝে করোনার লাল চোখ। প্রতি ২৪ ঘণ্টায় একের পর এক রেকর্ডের মাইলস্টোন পার। রাত ফুরোলেই ষষ্ঠ দফার নির্বাচন। তাই শেষ দুই দফার নির্বাচনে প্রচার পর্ব একবারে তুঙ্গে সমস্ত রাজনৈতিক দলের।

একটু ভালো করে একের পর এক হাইভোল্টেজ মিছিল লক্ষ্য করলে দেখা যাবে নেই মাস্ক।স্যানিটাইজারের ব্যবহার নেই। আর সামাজিক দূরত্ব বিধির কথা যত কম বলা যায় ততই ভালো! তবে এতে যেন এক প্রকার নির্বিকার রাজনৈতিক দলগুলি। ক্রমাগত মৃত্যু-মিছিল, হাসপাতাল চত্বরে অক্সিজেনের অভাবে রোগীর কাতরানি, স্বজন হারানোর বুকফাটা কান্না – কোনো কিছুই যেন চোখে পড়ছে না রাজনৈতিক নেতৃত্বদের। অবশ্য চোখে পড়েও পড়ছে না কি, তা অবশ্য বোঝা দায়।

এরই মাঝে কেন্দ্র বনাম রাজ্য তরজাতে অন্যতম বিষয়বস্তু হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে ভ্যাকসিন ও তার সঠিক প্রয়োগ।
করোনার বাড়বাড়ন্ত রুখতে যদিও তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইতিমধ্যেই শহর কলকাতায় আর বড় সমাবেশ করবেন না বলে জানিয়েছেন। তবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বঙ্গ জয়ের লক্ষ্যে তারা সভা-সমাবেশ কোনটাই কমাবেন না সাফ জানিয়ে দিয়েছেন।

যুক্তি দিয়ে বিজেপি নেতৃত্বরা বলেছেন প্রত্যেকটি সমাবেশ হবে কোভিড বিধি মেনে। সভায় আগত প্রত্যেক কর্মী-সমর্থকের করোনা পরীক্ষার নেগেটিভ রিপোর্ট পেলে তবেই এন্ট্রি দেওয়া হবে। বাস্তবে বিজেপির সাফাই কতটা যুক্তিযুক্ত তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন চিকিৎসক মহলের একাংশ। কোন জনসমাবেশ কোভিড বিধি মেনে করা একেবারেই সম্ভব নয়, জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা।

চলতি বছরে দেশজুড়ে করোনার রেকর্ড সংক্রমন

পার্শ্ববর্তী রাজ্যে গুলিতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ কার্যত বেসামাল করে দিয়েছে চিকিৎসা পরিকাঠামো। দিল্লি, মুম্বাই-র মত জায়গায় উন্নত চিকিৎসা পরিকাঠামো থাকা সত্বেও করোনাকে আয়ত্তে আনতে পারছেন না চিকিৎসকেরা। আপাতত বেশ কয়েকটি জায়গায় লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। তবে পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাচ্ছে তা বলা মুশকিল।

একুশের পশ্চিমবঙ্গের ভাগ্য নির্ধারিত হতে চলেছে। আর তার উপরেই নির্ভর করছে আমজনতার আয়ুষ্কাল। যেভাবে জেলা থেকে রাজপথ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এক একটি রাজনৈতিক দলের প্রচার কর্মসূচী তা দেখলে শিউরে উঠতে হয় বৈকি। উঠে আসছে একটি প্রশ্ন বারবার। ভোট আগে নাকি মানুষের জীবন? উত্তর অবশ্য জানা নেই।

আরও অবাক করেছে একটি বিষয়। করোনা আক্রান্ত রোগীরাও যাচ্ছেন ভোট দিতে। কিন্তু কেন? একজন করোনার আক্রান্ত রোগী শতাধিক মানুষের মধ্যে সেই রোগ ছড়িয়ে দেবার ক্ষমতা রাখে। তার পরেও কিভাবে নির্বাচন কমিশন তাদের গণতন্ত্রের উৎসবে শামিল হওয়ার অনুমতি দেয় তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।

২ মে ভোটের ফলাফলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে কুর্শি কার দখলে থাকবে। তারপর করোনা নিয়ে নতুন করে ভাবনাচিন্তা শুরু করবে ক্ষমতাসীন সরকার। কিন্তু ততদিনে অনেকটাই দেরি হয়ে যাবে না তো? কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে অপ্রতুল ভ্যাকসিন। একইসঙ্গে চড়চড়িয়ে বাড়ছে ওষুধের চাহিদা। হাসপাতালের বেড নেই। চিকিৎসকেরা বলছেন কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ ভয়ঙ্কর হতে পারে। তারপরেও কোন হেলদোল নেই কারোর।

যত্রতত্র মাস্কবিহীন অবস্থায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন মানুষজন। বারবার সতর্ক বার্তা করা হলেও তাতে কান দিচ্ছেন না বিশেষ কেউই। ইতিমধ্যেই প্রশাসনের তরফে মাস্ক বিহীন আম জনতার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। কিন্তু কেন? বারবার সতর্ক বার্তা দেওয়ার পরেও প্রশাসনকে মাস্ক পড়ানোর দায়িত্ব নিতে হবে?

প্রধানমন্ত্রীর নরেন্দ্র মোদী দেশবাসীর কাছে সবিনয় অনুরোধ জানিয়েছেন কোভিড বিধি মেনে চলার জন্য। অন্যথায় লকডাউন ছাড়া আর কোনো পথ নেই। গুটি কয়েক মানুষের জন্য প্রাণঘাতী করোনা ছড়িয়ে পড়ছে লাখ লাখ মানুষের মধ্যে। লকডাউনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা আমরা প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করেছি। কাজ হারিয়ে, খাবার না পেয়ে হাজার হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। কজনেরই বা খোঁজ রাখি আমরা!

জানিনা গণতন্ত্রের এই উৎসবের আনন্দে শামিল হতে গিয়ে নিজেদের অজান্তে আরো বিপদ ঘনিয়ে আসছে কিনা। যে দলই ক্ষমতায় আসুন, তাদের কাছে আগাম বিনীত অনুরোধ করোনা প্রতিরোধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার। গণতন্ত্রের উৎসবে শামিল হতে গেলে বেঁচে থাকাটা খুব প্রয়োজন। না হলে অচিরেই সভ্যতার সমাপ্তি ঘটবে তা নিঃসন্দেহে স্পষ্ট।

সম্পর্কিত পোস্ট