গণতন্ত্রের উৎসবে বিপন্ন গণদেবতা, ক্ষমতার আস্ফালনে অন্ধ ‘ভিক্ষুক’-রা

নয়ন রায় , এডিটর ইন চিফ

হাতে মাত্র একটা গোটা দিন। তারপই জলের মত পরিস্কার হয়ে যাবে বঙ্গযুদ্ধে জয়ী কারা হলেন। আর কার হাতেই বা জনগণ আগামী ৫ বছরের রাজ্যপাট তুলে দিলেন। তবে একটা জিনিস এবারের নির্বাচনে স্পষ্ট। আমজনতা ভোটের ‘তাস’। কারণ এরাজ্যের রাজনীতিবিদরা শুধু ভোটটাই চান। ভোটারদের নয়।

করোনার বাড়বাড়ন্তে প্রতিদিন মৃত্যু মিছিলের সাক্ষী থাকছে পশ্চিমবঙ্গ সহ তামাম ভারতবর্ষ। ২৬ ফেব্রুয়ারী এরাজ্যে ভোট ঘোষণার পর থেকে ৮ দফার নির্বাচনে মিটিং-মিছিল-রোডশো-জনসভাতে ক্লাইম্যাক্স ছিল ভরপুর। তখন সমস্ত রাজনৈতিক দলের একটাই লক্ষ জনসমাগম। বড় বড় ক্যামেরায় তখন মাথা গুনতে ব্যস্ত তারা। বিষয়টা হল- “হাম কিসি সে কম নেহি…”

তবে বড় বড় ক্যামেরায় বা ড্রোনে মাথা গোনা সম্ভব হলেও চোখে পড়েনি বা পড়া সম্ভব নয়, করোনার সংক্রমণ কীভাবে তিলে তিলে গোটা রাজ্যের কোনায় কোনায় ছড়িয়ে পড়ছে। তখন শুধু প্রতিশ্রুতির বন্যা। কুকথায় কাকে কতটা ছোট করা যায়, পাল্লা দিয়ে তার প্রতিযোগীতা চলছে। সতর্ক করেছেন চিকিৎসকেরা। তবে তাতে কর্ণপাত করেনি কেউই।

টনক নড়েনি নির্বাচন কমিশনেরও। মানুষ মারা যাচ্ছে। অক্সিজেনের অভাব। হাসপাতালে বেড নেই। ওষুধ নেই। টীকা নিতে গিয়ে চূড়ান্ত হয়রানি। সেসব দিকে নজর না দিয়ে নিজেদের ঢাক পেটাতে ব্যস্ত রাজনৈতিক দলগুলি।

দেশের প্রধানমন্ত্রীর যখন সেই দিকে নজর দেওয়া উচিত, তিনি তা না করে ব্যস্ত থাকলেন রাজনৈতিক প্রচারে। তাঁর গলায় “দিদি..ও দিদি…” ডাকে উদ্বেল গোটা রাজ্য। পাল্টা এরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মেতে উঠলেন ভোটবাজারে “খেলা হবে” স্লোগানে। রীতিমত হুইল চেয়ারে বসে বল ছুঁড়ে খেলার সূচনা করছিলেন তিনি।

আসল খেলা কোথায় হল ?  ঢাক-ঢোল-ডঙ্কা বাজিয়ে জয় বাংলা ও জয় শ্রীরাম স্লোগানে তখন খেলা হচ্ছে। আর তাতে ফুটবলের মত ব্যবহার করা হল বাংলার মানুষকে। আর ভোট মিটতেই আংশিক লকডাউনের ঘোষণা করল রাজ্য সরকার। আর আমাদের প্রশ্ন এখানেই।

কেন এতদিন আপনাদের মনে পড়ল না করোনা রুখতে নিষেধাজ্ঞা ও নিয়ন্ত্রনের কথা? পেশি শক্তির আস্ফালন দেখালেন কোথাও মঞ্চ বেঁধে, আবার কোথাও হুড খোলা গাড়িতে। তখন কেন মনে পড়ল না করোনা রোখার কথা?

ভোট বড় বালাই।গণতন্ত্রের উৎসবে গণদেবতাকে প্রসাদ হিসাবে অর্পণ করা হয় নির্বাচনী ইস্তেহার, প্রতিশ্রুতির রচনা। তারপর কোথাও বৃদ্ধা মহিলাকে নিজের মা হিসাবে তুলে ধরা। শ্রমিক-কৃষক-দিনমজুরদের ক্ষেতে খেটে কড়া পড়ে যাওয়া পা গুলিতে হাত দিয়ে প্রণাম। কোথাও আবার তাদের ঘর্মাক্ত গায়ে জড়িয়ে ধরে পাশে থাকার আশ্বাস।

সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখা গেছে শৌচালয়ের অভাবে রাস্তার ধারে স্নান করছেন এক মাঝবয়সী যুবক। গোটা গা সাবানে ভর্তি। তাকে সাবান মাখিয়ে চান করিয়ে ভোট ভিক্ষা করছেন এক অভিনেতা ও রাজনৈতিক নেতা। যদিও তাঁকে দুঁদে রাজনীতিবিদ বলা যাবে নাকি ভেবে দেখতে হবে।

এত প্রসাদের মাঝে যার অর্পণ করা প্রসাদ জনগণের মন ছুঁয়ে যায় সেই রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় আসেন। তারপরই এক ফুঁয়ে নিভে যায় এতদিনের প্রতিশ্রুতি। গণদেবতার আশীর্বাদের কথা তখন আর মনে থাকে না।

সমস্ত রাজনৈতিক দলের কাছে প্রশ্নঃ

১. আপনারা ভেবেদেখেছন, কোভিড বিধি লঙ্ঘন করে প্রচারের ফল কী হতে পারে? যদিও আর ভেবে দেখতে হবে না। কারন ফল ফলছে…

২. ভেবেছেন লকডাউনে সমাজের বুনিয়াদি স্তরের নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষগুলির রোজগার কীভাবে হবে? কীভাবে সংসার চলবে তাদের?

৩. করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন মানুষ। এখনো অনেক সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে নেই প্রাথমিক চিকিৎসা পরিকাঠামো। নেই অক্সিজেন-বেড। এই দায় কার?

৪. করোনার টিকা নিয়ে প্রতিদিন রাজনীতির স্বীকার হচ্ছেন দেশের মানুষ। রাজ্যের মানুষ। বৈষম্য দাম নিয়ে। কালোবাজারি শুরু হয়ে গিয়েছে। এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর দায় কার?

৫. রেশন নিয়ে টানাপোড়েনের সাক্ষী গোটা এক বছর ধরে বাংলার মানুষ দেখেছে। তখন অবশ্য এরাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনকে লক্ষ্য করেই রেশন নিয়ে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলি। তাতে নিজের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছেন অনেক সাধারণ মানুষ। এ দায় কার?

৬. যেদলই ক্ষমতায় আসুক বেকাররা সত্যি চাকরী পাবে তো? কৃষকদের ঝ়ড়-জল মাথায় নিয়ে ফসলের ন্যায্য দামের দাবিতে আর পথে বসতে হবে না তো?

৭. আচ্ছা আপনাদের মনে আছে, গতবছরের লকডাউনে মৃত মা-কে জীবিত মনে করে স্টেশনে অবিরত “মা মা’ বলে ডেকে যাওয়া শিশুটির কথা? বা ঘুমন্ত শিশুকে ট্রলিতে চাপিয়ে হেঁটে চলেছেন মা- সেই দৃশ্যের কথা?

৮. আদৌ মনে আছে পরিযায়ী শ্রমিকদের সেই চরম অসহায়তার কথা? তখন কেন চাটার্ড বিমান পাওয়া গেল না? কেন ট্রেনের ভাড়া নিয়ে রাজনৈতিক টানাপোড়েন শুরু হল?  নাকি ভোটারদের রাজ্যে ফিরিয়ে ভোটবাক্স সুরক্ষিত করাই আপনাদের মূল লক্ষ্য ছিল?

এমন লাখো প্রশ্নের ভিড় মন ও মস্তিস্কে দ্বন্দ্ব চালিয়ে যাচ্ছে। মাদ্রাজ হাইকোর্টের প্রশ্নের মুখে কেন্দ্রীয় সরকারের অকপট স্বীকারোক্তি তারা বুঝতে পারেননি করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আসতে পারে। যদি নাই বা বোঝেন চিকিৎসকদের সতর্কবাণী উপেক্ষা কেন করলেন? কেন এতগুলো মানুষের জীবন ভোটবাজিতে লাগিয়ে দিলেন?  আমজনতা কী সত্যিই ফেলনা?

২ তারিখ যেকোনো একটি রাজনৈতিক দল পশ্চিমবঙ্গের কুর্সি দখল করবে।এটাই গণতন্ত্রের নিয়ম। তা সে যেই হোক না কেন তাদের কাছে আমাদের অনুরোধ, মানুষের জীবন নিয়ে খেলা এবার সত্যিই বন্ধ হোক। এমন খেলা আমরা চাইনি। পূরণ হোক আমজনতার একটু ভাল থাকার ইচ্ছা।

আর সরকারের ব্যর্থতা হোক বা সাফল্য আমাদের কলমের প্রতিবাদের ভাষা জারি থাকবেই….

সম্পর্কিত পোস্ট