দেউচা পাচামি কী? কেন মমতা এই ‘অসম্ভব’কে সম্ভব করতে চাইছেন? পর্ব-১
কৌস্তভ
ওমিক্রণের ধাক্কায় (চিকিৎসকদের একাংশের মতে) রাজ্যে হু হু করে বাড়ছে করোনা সংক্রমণ। সেই কারণেই গত দুই সপ্তাহ ধরে খবরের আড়ালে চলে গিয়েছে বীরভূমের দেউচা পাচামি কয়লাখনি প্রকল্প। কিন্তু আজ না হলে কাল, বেশ কিছুদিনের জন্য যাবতীয় খবর যে এই দেউচা পাচামিকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হবে তা হলফ করে বলা যায়।
হয় এশিয়ার সর্ববৃহৎ কয়লাখনি প্রকল্প বাস্তবায়িত করার সাফল্যে উদ্বেল হয়ে উঠবে রাজ্যের শাসক দল, নাহলে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ঐতিহ্য মেনে বড়সড় রাজনৈতিক ধাক্কা খাবেন রাজ্যের জমি আন্দোলনের নতুন ‘পথ প্রদর্শক’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়!
কিন্তু যে দেউচা পাচামিকে নিয়ে এতো বিতর্ক সেটি আসলে কী সেটা কিন্তু অনেকেই জানেন না। বেশিরভাগের কাছেই এটা আর একটা খনি প্রকল্পই শুধু। সেই প্রকল্প বাস্তবায়িত করতে গিয়ে অনেককে উচ্ছেদ করতে হবে ও সেই উচ্ছেদ আটকাতে স্থানীয় বাসিন্দাদের বিক্ষোভ, এই সংক্রান্ত সমীকরণের মধ্যে অনেকেই আটকে আছেন।
কিন্তু প্রকৃত বিষয়টি অনেকটাই আলাদা। আদৌ ‘টেকনিক্যালি’ এই দেউচা পাচামি প্রকল্প বাস্তবায়িত করা যাবে কিনা তা নিয়েই বড়সড় সংশয় আছে। আবার এটাও ঠিক এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে মুখ্যমন্ত্রীর কথামতো সত্যিই আগামী ১০০ বছরের জন্য বাংলার যাবতীয় কয়লার সমস্যা মিটে যেতে পারে!
শুধু যে প্রকল্প এলাকায় বসবাসকারী আদিবাসীদের ঘিরে বিতর্ক তৈরি হচ্ছে তা নয়, বরং দেউচা পাচামির সঙ্গে রাজ্যের গণ্ডি ছাড়িয়ে সারা বিশ্বের পরিবেশের প্রশ্ন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। আসানসোল-রানীগঞ্জ কয়লাখনি অঞ্চলের পরিণতির উদাহরণ দেউচা পাচামি নিয়ে আরও ভয় ধরাচ্ছে মানুষের মধ্যে।
আবার এই প্রকল্পের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার খাতায়-কলমে যে ক্ষতিপূরণের প্যাকেজ ঘোষণা করেছে তা একপ্রকার অভাবনীয়। ভারতে আর কোনও সরকার এর আগে এই বিপুল পরিমাণ অর্থের ক্ষতিপূরণ দিয়েছে কিনা তা নিয়েও সন্দেহ আছে। অর্থাৎ বীরভূমের মহম্মদ বাজার ব্লকের দেউচা পাচামি কয়লাখনি প্রকল্পকে সরল আর পাঁচটা সমীকরণ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করলে কিছুই বুঝে ওঠা যাবে না।
প্রথমে দেউচা পাচামি কয়লাখনি প্রকল্পটির বৈশিষ্ট্য নিয়ে কিছু তথ্য জেনে নেওয়া যাক।
গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের একেবারে প্রথমভাগেই জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া জানায় দেউচা পাচামিতে বিপুল পরিমান কয়লা সঞ্চিত হয়ে আছে। সেই খবর শুনে স্বাভাবিকভাবেই কেন্দ্রীয় সরকার প্রবল উৎসাহী হয়ে উঠেছিল।
কারণ দেশে বিপুল পরিমান কয়লা পাওয়া গেলে বিদেশ থেকে কয়লা আমদানি কমবে। তাতে বৈদেশিক অর্থ খরচ হ্রাস পাবে, চাঙ্গা হবে দেশের অর্থনীতি। এ প্রসঙ্গে একটা বিষয় জেনে নেওয়ার, খনিজ পদার্থ পুরোপুরিভাবে কেন্দ্রের মালিকানাধীন। তো দ্রুত সার্ভে শুরু হয় দেউতা পাচামিতে। তখনই জানা যায় বিপুল পরিমান কয়লা সঞ্চিত হয়ে থাকলেও তা উত্তোলন করা মারাত্মক কঠিন!
কারণ, পুরু ব্যাসল্টের আস্তরণ ঘিরে রেখেছে এখানকার কয়লার স্তরকে। তাও যদি ব্যাসল্টের একটি স্তর থাকতো তাহলেও না হয় কথা ছিল। কিন্তু ভূবিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন দেউচা পাচামিতে কয়লার প্রতিটি স্তরের মাঝে মাঝে ব্যাসল্টের একটি করে স্তর আছে। এই ব্যাসল্টের স্তর কেটে কয়লা উত্তোলনের প্রযুক্তি দেশে নেই।
দীর্ঘ ওঠাপড়ার ঐতিহ্যমণ্ডিত ত্রিপুরায় তৃণমূলের চালকের আসনে রাজীব
চিন, অস্ট্রেলিয়ার মতো হাতে গোনা দু-তিনটি দেশ এই প্রযুক্তির অধিকারী। কিন্তু সে প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে কয়লা উত্তোলনের বিশেষ অভিজ্ঞতা তাঁদের নেই। বিশেষত এইরকম জটিল কয়লা ক্ষেত্র এখনও অব্দি বিশ্বের আর কোথাও নেই। ফলে কাজটি নিয়ে একটা সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে দেউচা পাচামিতে সঞ্চিত কয়লার পরিমাণ ঠিক কতটা তা জানার জন্য যে বিশেষ ‘বোরিং’ প্রক্রিয়া হয় তাও করা সম্ভব হয়নি। কারণ এক্ষেত্রেও ব্যাসল্টের স্তর ভেদ করে বিষয়টি জানতে হবে। এই সংক্রান্ত প্রযুক্তিও দেশে নেই।
দেউচা পাচামি কী?
ভারতের প্রধান কয়লা উত্তোলক সংস্থা, রাষ্ট্রয়ত্ত কোল ইন্ডিয়ার বিশ্বজোড়া নাম আছে। কিন্তু তারাও এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তির অধিকারী নয়। এই পরিস্থিতিতে নব্বইয়ের দশকের মধ্যবর্তী সময়ে কোল ইন্ডিয়া কেন্দ্রকে জানিয়ে দেয় তারা দেউচা পাচামি প্রকল্প নিয়ে কিছু ভাবছে না।
পরবর্তীকালে কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ঝাড়খণ্ড সহ দেশের মোট ৬ টি রাজ্য সরকারকে নিয়ে একটি জয়েন্ট ভেঞ্চার বা কনসোর্টিয়াম তৈরি করার উদ্যোগ নেয়। লক্ষ্য ছিল সকলে মিলে এই বিপুল পরিমাণ কয়লা উত্তোলনের ব্যবস্থা করবে।
কিন্তু দেউচা পাচামির আরেক বিপদের কথা মাথায় রেখে বাকি রাজ্যগুলি পিছু হটতে শুরু করে। এমনকি বছর পাঁচেক আগে কেন্দ্র ফের কোল ইন্ডিয়ার সঙ্গে কথা বললে তারা নতুন করে পর্যালোচনা করে জানিয়ে দেয় এখান থেকে কয়লা উত্তোলন করতে গেলে বড়সড় ঝুঁকির সম্মুখীন হতে হবে।
চলবে….