দেউচা পাচামি কী? কেন মমতা এই ‘অসম্ভব’কে সম্ভব করতে চাইছেন? পর্ব-২

কৌস্তভ

বছর পাঁচেক আগে কেন্দ্র ফের কোল ইন্ডিয়ার সঙ্গে কথা বললে তারা নতুন করে পর্যালোচনা করে জানিয়ে দেয় এখান থেকে কয়লা উত্তোলন করতে গেলে বড়সড় ঝুঁকির সম্মুখীন হতে হবে।

দেউচা পাচামি কী? কেন মমতা এই ‘অসম্ভব’কে সম্ভব করতে চাইছেন? পর্ব-১

কী সেই ঝুঁকি?

দেউচা পাচামিতে সঞ্চিত কয়লাকে যেহেতু ব্যাসল্টের স্তর মুড়ে রেখেছে এবং এখানে কয়লার একেকটি স্তর ১০০ মিটারের বেশি পুরু, তাই এখানে কয়লা উত্তোলন করতে গেলে প্রচুর পরিমাণে তাপ উৎপন্ন হতে পারে।

এক্ষেত্রে একটা জিনিস মাথায় রাখতে হবে অন্যান্য ক্ষেত্রে কয়লার স্তর ৪-৫ মিটারের বেশি পুরু হয় না। বিশেষজ্ঞরা জানান এখান থেকে কয়লা উত্তোলন করার সময় প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় প্রবল পরিমাণে তাপ উৎপন্ন হয়ে বড়োসড়ো অগ্নিকাণ্ড ঘটার আশঙ্কা আছে।

কোল ইন্ডিয়া এই কারণটিকে সামনে রেখে চূড়ান্তভাবে জানিয়ে দেয় তারা দেউচা পাচামি নিয়ে আগ্রহী নয়। পরবর্তীকালে ২০১৮ সালে রাজ্যে কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে মমতা সরকার এককভাবে দেউচা পাচামি কয়লাখনি প্রকল্প এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ছাড়পত্র দেয় কেন্দ্র। সেই সময় বেশ কিছু বিশেষজ্ঞ জানান এখানে এশিয়ার সবচেয়ে বেশি পরিমান কয়লা সঞ্চিত থাকলেও তার গুণগতমান বিশেষ ভালো হবে না।

বিশেষজ্ঞদের মতে চিন বা অস্ট্রেলিয়া থেকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এনে দেউচা পাচামিতে কয়লাখনি প্রকল্পের কাজ শুরু হলেও ব্যাসল্ট স্তর কেটে প্রথম কয়লা উত্তোলন করতে, প্রকল্পের কাজ শুরুর প্রথম দিন থেকে হিসেব করে কম করে ৫ বছর সময় লাগবে! ফলে এই প্রকল্প বাণিজ্যিকভাবে আদৌ কতটা লাভজনক হবে তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মনে সংশয় আছেই।

দেউচা পাচামি কয়লাখনি প্রকল্পের ভূতাত্ত্বিক জটিলতা মোটামুটি বোঝা গেল। এবার পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রস্তাবিত কয়লাখনি প্রকল্পটি নিয়ে কিছু বিষয় জেনে নেওয়া যাক-

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার মহম্মদ বাজার ব্লকের দেউচা পাচামিতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার একর জমির উপর এই কয়লা ষখনি প্রকল্প তৈরি করতে চাইছে। এর মধ্যে এক হাজার একর সরকারের হাতে থাকা খাস জমি। তাই সেটা নিয়ে বিশেষ কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু বাকি আড়াই হাজার একর জমি নিয়ে যথেষ্ট জটিলতা আছে। এই জমিতে অসংখ্য আদিবাসী পরিবার বসবাস করে। সেইসঙ্গে বেশকিছু পাথর ভাঙা শিল্প আছে এখানে।

সরকারি তথ্য বলছে দেউচা পাচামি কয়লাখনি প্রকল্প এলাকায় প্রায় ২০ হাজার আদিবাসীর বসবাস। তাদের একাংশ সরকারি ক্ষতিপূরণের প্যাকেজ গ্রহণ করতে চাইলেও বেশিরভাগ আদিবাসী নিজেদের ভিটেমাটি ছাড়তে রাজি নয়।

যদিও পশ্চিমবঙ্গ সরকার আদিবাসীদের বিঘে পিছু ১০-১২ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সেইসঙ্গে মহম্মদ বাজার ব্লকের‌ই অন্যত্র গ্রামীণ পরিবেশে তাদের নতুন বাড়ি ঘর বানিয়ে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি পরিবারের একজন করে সদস্যকে হোম গার্ডের চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে রাজ্য সরকার।

এছাড়া পাথর ভাঙা শিল্পের মালিক, শ্রমিক ও চাষিদের জন্য অতিরিক্ত ক্ষতিপূরণের বন্দোবস্ত আছে। এমনকি বাড়ির সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়ার জন্য ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা করে অতিরিক্ত ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে রাজ্য।

সব মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই কয়লাখনি প্রকল্পে ৩৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের কথা ঘোষণা করেছে। তার মধ্যে ১০ হাজার কোটি টাকা শুধু ক্ষতিপূরণ বাবদ‌ই খরচ হবে বলে জানানো হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিজে জানিয়েছেন দেউচা পাচামি কয়লাখনি প্রকল্পের ফলে প্রায় এক লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান হবে।

সত্যি কী একটা কয়লা খনি প্রকল্পে এক লক্ষের কর্মসংস্থান হওয়া সম্ভব?

বিশেষজ্ঞরা কিন্তু একটু অন্য কথাই বলছেন। আগের থেকে কয়লাখনিতে প্রযুক্তির অনেক উন্নতি ঘটেছে। তবু এখনও অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হয় কয়লাখনিতে। কিন্তু দেউচা পাচামিতে যে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োজন তাতে সরাসরি বিশেষ একটা কর্মসংস্থান হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ বেশিরভাগ কাজই হবে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে। সেখানে কিছু উচ্চমানের ইঞ্জিনিয়ারের প্রয়োজন আছে। এদিকে সেরকম ইঞ্জিনিয়ার বাংলায় যথেষ্ট কম পাওয়া যায়।

তবে পরোক্ষভাবে এই কয়লাখনি প্রকল্প অনেকেরই কর্মসংস্থান হ‌ওয়ার কথা। কিন্তু তাতে সংখ্যাটা কখনোই এক লক্ষের কাছাকাছি যে নয় তা হলফ করে বলা যায়।

দেউচার আদিবাসীদের আপত্তির জায়গা কী কী?

প্রথমে একটা বিষয় স্পষ্ট স্বীকার করে নিতেই হবে, এই দেশে আইন করে আদিবাসীদের জায়গা-জমি সংরক্ষণের অধিকার দিলেও তা আজ অব্দি কোন‌ও সরকারই মেনে নেয়নি। তাই দেশ স্বাধীন হ‌ওয়ার পরেও বারবার ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হতে হয়েছে আদিবাসীদের।

অতীতের সেই সব তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা মাথায় রেখেই বাস্তু ভিটে ছেড়ে যেতে রাজি নন দেউচার আদিবাসীরা। সেই সঙ্গে তাঁদের আরও একটি আশঙ্কা অতি সঙ্গত। সত্যি যদি এই কয়লাখনি প্রকল্প সফল হয় তবে আসানসোল-রাণীগঞ্জের মতো দেউচা পাচামিকে কেন্দ্র করে বীরভূমের মহম্মদ বাজার ব্লকের জনসংস্কৃতি সম্পূর্ণ বদলে যাবে।

অথচ এখানকার অধিবাসীরা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা গ্রাম্য পরিবেশে নিজেদের মতো করে বাঁচতে অভ্যস্ত। আমার-আপনার মতো হুজুগে সংস্কৃতিতে আজ‌ও গা ভাসাতে পছন্দ করেন না বেশিরভাগ আদিবাসী। তাঁরা দীর্ঘদিনের নিজস্ব সংস্কৃতির মধ্যেই যাপন করে আসছেন। তাই চারপাশের সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের আশঙ্কাতেও ভুগছেন এখানকার আদিবাসীরা।

তবে রানীগঞ্জ-আসানসোলের উদাহরণ আরেকটি আশঙ্কা তৈরি করছে। এই আশঙ্কায় শুধু আদিবাসীরা নয় ভূবিজ্ঞানীরাও ভুগছেন। আসানসোল-রানীগঞ্জ অঞ্চলের কয়লাখনির গভীরতা অনেক কম। তা সত্ত্বেও সেখানে পরিতক্ত কয়লাখনির জন্য নিয়মিত ধস নামে।

এদিকে দেউচায় কয়লা স্তর অনেক বেশি পুরু হওয়ায় এখানে ধসের পরিমাণ ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা। এমনকি মহম্মদ বাজার ছাড়িয়ে আশপাশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল এই ধসের কবলে পড়ে যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

উল্লেখ্য এখানে কয়লার পুরু স্তরের জন্য কয়লাখনির গভীরতা এক কিলোমিটারের‌ও বেশি হতে পারে! বুঝতেই পারছেন এখানে ধস নামলে তার পরিণতি ঠিক কতটা মারাত্মক হতে পারে!

তবে আরও একটি বড় আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন এখানকার আদিবাসীরা। তার সঙ্গে তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ নয়, বরং আমার-আপনার সকলের ভবিষ্যৎ জড়িত। বর্তমানে পরিবেশ দূষণ যে ভয়াবহ জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে তাতে কয়লা সহ সমস্ত জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

এদিকে দেউতা পাচামিতে কয়লাখনি প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে তা একটি আদ্যোপান্ত খোলামুখ কয়লাখনি প্রকল্প হবে, যাতে সবচেয়ে বেশি দূষণ ছড়ায়।

এখানকার অধিবাসীরা এই দূষণের বিষয়টিকেও সামনে তুলে ধরে প্রকল্পের বিরোধিতা করছেন। একটা বিষয়ে সব সময় মাথায় রাখতে হবে, আমার-আপনার থেকে প্রকৃতির স্পন্দন অনেক ভাল বোঝেন আদিবাসীরা। কারণ তাঁরা ওই প্রকৃতির কোলেই আজন্ম লালিত হয়ে চলেছেন।

সম্পর্কিত পোস্ট