বিধানসভা ভোটে কোথায় ‘চিন্তা’ তৃণমূলের ?

অয়ন দাশ

বাংলায় আগামী বিধানসভা নির্বাচনে বাকি মেরেকেটে আর মাত্র নয় মাস। শাসক তৃণমূল কংগ্রেস থেকে শুরু করে বিরোধী বিজেপি অথবা বাম-কংগ্রেস জোট কমবেশি রাস্তায় নেমে পড়েছে সব দলই। করোনা ,আমফানের জোড়া ফলায় পরিস্থিতি কিছুটা জটিল হলেও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বিরত থাকেনি।

২১শের নির্বাচনের আগে কেমন অবস্থায় আছে শাসক তৃণমূল কংগ্রেস? ক্ষমতায় বহাল থাকার পথ কতটা মসৃণ তাঁদের জন্য ? সাংগঠনিক ভাবে কতটা প্রস্তুত তাঁরা ?

গত লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিল শাসক তৃনমূলের ভুল – ত্রুটি।  লোকসভা নির্বাচনের পরেই তৃণমূল কংগ্রেস দ্বারস্থ হয় ভোট গুরু প্রশান্ত কিশোরের। দায়িত্ব নিয়েই তিনি ঝাঁপিয়ে পরেন লোকসভা নির্বাচনে বিপর্যয়ের কারণ খুঁজতে।

তালিকায় প্রথমেই উঠে আসে পঞ্চায়েত ভোটের প্রসঙ্গ। কার্যত ত্রিশ শতাংশ আসনে বিরোধীদের মনোনয়ন না করতে পারা। এই কারনেই গ্রামীণ ভোট ব্যাঙ্কে বিরাট ধস নামে শাসক দলের।

সেই সঙ্গে নিচুতলায় একাধিক গোষ্ঠীর লড়াই। কোথাও অযোগ্যকে পদ পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ। কোথাও মাদার তৃণমূলের সঙ্গে যুব তৃণমূলের এলাকা দখলের লড়াই। কিছু জায়গায় নিজেদের লড়াইয়ে কর্মীর মৃত্যুর অভিযোগ। কয়েকজন নেতার পাঁচ- ছয় বছরে প্রসাদসম বাড়ি – দামি গাড়ি দলের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দেয় সাধারণ মানুষের মনে।

দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারবার দলে সচ্ছতার কথা বললেও কার্যত তা কর্ণপাত করেনি দলেরই একটা অংশ। যার জের গিয়ে পরে লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে। প্রশান্ত কিশোরের সংস্থা আই প্যাক শুরু থেকেই দলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে সচেষ্ট হয়। শুরু করেন দিদিকে বলো কর্মসূচী । প্রাথমিকভাবে সফলও হয় কর্মসূচী।

তিনটি উপনির্বাচন থেকে যার সুফল পায় তৃণমূল কংগ্রেস। তবে করোনা পরিস্থিতি আবার কিছুটা বেকায়দায় ফেলে দেয় শাসক দলকে। কোথাও বিনা চিকিৎসায় রোগী মৃত্যুর অভিযোগ, আবার কোথাও পাহাড় প্রমাণ বিল।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবেদন করলেও তাতে সাড়া দেয়নি অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতাল। তাঁদের স্বেচ্ছাচার মনোভাব সাধারণ মানুষের মনে একাধিক প্রশ্ন তুলেছে।

এই পরিস্থিতিতেও রেশন দুর্নীতি নিয়ে জেরবার হতে হয়েছে উত্তর থেকে দক্ষিণে। সাধারণ মানুষের সেই ক্ষোভ প্রশমিত করতে একাধিক ক্ষেত্রে কড়া পদক্ষেপও গ্রহন করেছে সরকার। করোনা পরিস্থিতির মধ্যেই রাজ্যের উপর নেমেছে আমফানের মত প্রাকৃতিক বিপর্যয়। যে ঝড়ে বিপর্যস্ত হয়েছে রাজ্যের একটা বড় অংশ।

ঝড়ের ক্ষতিপূরণ বাবদ আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করা হয় রাজ্য সরকারের তরফে। সেই ক্ষতিপূরণ নিয়েও উঠে আসে একধিক স্বজন পোষণ ও দুর্নীতির অভিযোগ। পঞ্চায়েত প্রধান, সাধারণ সদস্য থেকে সমিতির সদস্য কারুর বিরুদ্ধে নিজের নামে টাকা নেওয়ার অভিযোগ অথবা পরিবারের সদস্য বা কাছের লোকেদের টাকা পাইয়ে দেওয়া।

এর বিরুদ্ধে দিকে দিকে শুরু হয় বিক্ষোভ। দলেরই একটা অংশ অন্য অভিযোগ জানায় অন্য অংশের বিরুদ্ধে। দলীয় ভাবে কিছু নেতার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানও গ্রহন করতে হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসকে। একাধিক জায়গায় নতুন তালিকা তৈরির নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।

http://sh103.global.temp.domains/~lyricsin/thequiry/northbengal-minister-rabindranath-ghosh/

আমফানের জেরে কলকাতা সহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে যায় বিদ্যুৎ বিপর্যয়। বিদ্যুতের দাবীতে পথে নেমে বিক্ষোভে সামিলও হন মানুষ।

কলকাতার বিদ্যুৎ সরবরহকারি সংস্থা সিএসসির বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগড়ে দেয় কলকাতাবাসী। আনলক প্রক্রিয়ার শুরু থেকে গণ পরিবহন নিয়েও একাধিক প্রশ্ন ওঠে।

দুর্ভোগের চিত্র ধরা পরে উত্তর বঙ্গ থেকে দক্ষিণ বঙ্গ পর্যন্ত। ইতিমধ্যেই রাজ্যে ধীরে ধীরে বর্ষার আগমন ঘটছে। সঙ্গে আসছে সেই চেনা জল যন্ত্রণা।

পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল থেকে শুরু করে হুগলীর খানাকুল সহ হাওড়ার আমতা ও উদয়নারায়ানপুরের একটা বড় অংশ জলের নীচে চলে গেছে।

দীর্ঘ নয় বছর ক্ষমতায় থাকার পরেও এই যন্ত্রণা উপশমে কি ভূমিকা রাজ্য সরকার নিয়েছে তা নিয়ে জনমানসে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য।

শুধু মাত্র চৌত্রিশ বছরের বাম সরকারের উপর দোষারোপ করে দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা ফলপ্রসূ নাও হতে পারে। তাহলে এই নয় বছরে কাজের ক্ষতিয়ান নিয়ে প্রশ্নও উঠতেই পারে।

দুর্নীতি, নিজেদের মধ্যে লড়াইয়ের জেরে প্রচারের আড়ালে চলে যাচ্ছে একাধিক সামাজিক প্রকল্প। কন্যাশ্রী ,রুপোশ্রী, গতিধারা,আনন্দধারা, আমার ফসল আমার গোলা, গীতাঞ্জালি, জল ধরো জল ভরো, কর্মতীর্থ, মাটির কথা, পথসাথী, সবুজ সাথী সহ বিভিন্ন প্রকল্প পিছনের সারিতে চলে যাচ্ছে।

দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারবার নির্দেশ দিয়েছেন উন্নয়ন মূলক কাজকে প্রচারের হাতিয়ার করতে। এরই মধ্যে ২১শে জুলাইয়ের মঞ্চে দল ছেড়ে যাওয়া নেতা কর্মীদের মান- অভিমান ভুলে দলে ফিরে আসার আবেদন জানান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

দলের স্বচ্ছতা ফেরাতে একধিক পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে। কোথাও জেলা সভাপাতি বদল থেকে শুরু করে নতুন কমিটি গঠন। রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়, লক্ষ্মী রতন শুক্লা থেকে মহুয়া মৈত্র। ভরসা রাখা হয়েছে তরুণ স্বচ্ছ ভাবমূর্তির উপর।

আলাদা করে দেওয়া হয়েছে স্পোক পার্সেনদের নাম। যত্রতত্র যে কারুর মুখ খোলার উপর অলিখিত নির্দেশিকা দেওয়া হয়েছে। আলটপকা মন্তব্য একাধিকবার বিরাম্বনায় ফেলেছে দলকে।

বিধানসভা ভোটের আগে গোটা দলকে একটা সুতোয় বাঁধার চেষ্টা করছে টিম পিকে থেকে দলনেত্রী । সংখ্যালঘু ভোটের একটা বড় অংশের সমর্থন এখনও তৃণমূলের দিকে থাকায় কিছুটা এগিয়ে থেকেই ফাইনাল যুদ্ধে নামতে পারবে বর্তমান শাসক দল।

সরকার বিরোধী ভোটের প্রবণতাও কিছুটা বেকায়দায় ফেলতে পারে সরকারকে।  সেই সঙ্গে দ্রুত মেটাতে হবে গোষ্ঠী বাজির সমস্যা। যে অগোছালো বিজেপি বর্তমানে আছে সেটা ভোটের আগে থাকবে ভাবলে ভুল করা হবে।

ঘন ঘন রাজ্যে আগমন ঘটবে একাধিক হেভিওয়েট নেতার। প্রচারের ঝড় তুলতে একাধিকবার রাজ্যে আসবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী থেকে শুরু করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ।

তবে বিরোধী শক্তিকে ছোট করে দেখলে লোকসভা ভোটের মতই মাশুল গুনতে হতে পারে তৃণমূল কংগ্রেসকে। তবে বাংলার ভোটের আগে পাশের রাজ্য বিহারের ভোটের চিত্রের দিকেও নজর থাকবে রাজনৈতিক মহলের। সেই সঙ্গে করোনা পরিস্থিতে আদৌ সঠিক সময় ভোট হবার উপরও থাকছে বড় প্রশ্ন চিহ্ন।

সম্পর্কিত পোস্ট