স্বভাবমুখর মমতা দিল্লি নিয়ে নীরব কেন, উঠছে প্রশ্ন
।। শুদ্ধ ব্যানার্জি ।।
তাহলে কী দাঁড়ালো?
উত্তর-পশ্চিম দিল্লিতে হিন্দুত্ববাদীদের নেতৃত্বে গণহত্যা চললো। এখনো অবধি মৃত ৩৫। আহত তিন শতাধিক। শতাধিক বাড়ি, গাড়ি, দোকান জ্বলে পুড়ে ছাই। যে বিচারপতি মুরলিধর স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কপিল মিশ্র ও অন্যান্যদের বিরুদ্ধে এফআইআর করার আদেশ দিলেন, তারই বদলি হয়ে গেল মাঝরাতে। কয়েকটি মিডিয়া নেমে পড়লো এই গণহত্যায় আম আদমি পার্টির ভূমিকা প্রমাণ করতে। রাষ্ট্রসংঘের অধ্যক্ষ দিল্লির পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেন। জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের চেয়ারম্যান অজিত ডোভাল প্রেসের সামনে এলেন এবং এক পীড়িত কিশোরীর প্রশ্নের সামনে কোনও রকমে উত্তর দিয়ে পালালেন।
কংগ্রেস দিল্লির বুকে প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর নেতৃত্বে পদযাত্রা করলো। কংগ্রেস সভাপতি সোনিয়া গান্ধী রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের পদত্যাগ দাবি করলেন। রাষ্ট্রীয় জনতা দলের তেজস্বী যাদব একই দাবি তুললেন।
আর বাংলার স্বভাবমুখর মুখ্যমন্ত্রী টানা দু’দিন চুপ করে থাকার পর পুরীর মন্দিরে রঙিন চাদর জড়িয়ে, জগন্নাথের ছবি নিয়ে ছবি তুলে যা বক্তব্য রাখলেন, তা পিকে’র সৃষ্ট জগন্নাথ-ভক্ত মমতার হলেও, সিএএ-এনআরসি বিরোধী, বাংলার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোট পাওয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নয়। তাঁর বিনয়ী বক্তব্য শুনে বোঝা যায় না তিনি আদৌ কোনও দিন যুদ্ধং দেহি মনোভাব নিয়েছিলেন। কেনই বা দিল্লিতে মুসলমান নিধনের যজ্ঞের সময়, কারণে অকারণে ‘হিজাব ‘ পরতে খ্যাত মুখ্যমন্ত্রী মুখে কুলুপ এঁটে রইলেন?
কেনই বা, যে অমিত শাহের ভূমিকা নিয়ে সারা দেশ নিন্দামুখর, সেই অমিত শাহের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী ভুবনেশ্বরে দেখা করতে যাচ্ছেন? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দফতরের কাজ সুরক্ষা নিয়ে। সেখানে অফিসারদের মধ্যে মিটিং হওয়াই রীতি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজ্যকে জনস্বার্থে কোনও অনুদান দেন না যে, মূখ্যমন্ত্রী নিজে কথা বলে অনুদানের পরিমাণ বাড়িয়ে আনবেন। তাহলে??????
তাহলে কি নিম্নলখিত প্রশ্নগুলি ওঠা উচিত নয়?
আরও পড়ুনঃ নীরব দর্শকের ভূমিকায় কেন্দ্র সরকার, মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৩৪, তোপ কংগ্রেসের
– যেভাবে তৃণমূল সরকারের সময় বিজেপি-আরএসএস এ রাজ্যে আকারে ও সংখ্যায় বেড়েছে, তেমনই ‘প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতা কি’ আবার শুরু হবে?
– এ কথা স্পষ্ট যে তৃণমূল বিজেপি নামক ইঁদুরকে বাঘ করলেও, সেই বাঘকে ইঁদুর করার ক্ষমতা তাদের নেই। কারণ দিদির দলের সারদা, নারদা, রোজভ্যালি সহ হাজার দুর্নীতির জন্য শাস্তির চাবিকাঠি মোদি-শাহেদের হাতে আছে। এখন চাবি যেদিকে ঘুরবে পুতুলকে ওদিকে নাচতে হবেই। প্রধানমন্ত্রীর মিটিংয়ে যাওয়া হেলায় বাতিল করা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে মিটিং কেন বাতিল করতে পারছেন না। চাপটা ঠিক কোথায়?
– দিল্লিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় প্রাণ খুলে আপকে ভোট দিলো। শেষ অবধি নিজেদের ক্ষমতায় নিজেদের লড়তে হলো। মরতে হলো। ৬১ জন বিধায়ক থাকা দলের মুখ্যমন্ত্রী টুইট করে দায়িত্ব সারলেন। বললেন, আইনশৃঙ্খলা আমার কাছে নেই। আমার প্রশ্ন, ২০১৩;সালে যখন সামান্য অছিলায় মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ প্রজাতন্ত্র দিবসের ঠিক আগে সংসদ মার্গে দু’রাত ক্যামেরার সামনে ধরনা দিলেন, তখনও কি তাঁর হাতে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের অধিকার ছিল? রামলীলা ময়দানে এক লাখ লোক নিয়ে শপথ নিলেন কদিন আগে। বললেন, প্রতি সপ্তাহে দিল্লিতে রামায়ণের সুন্দর কান্ড পাঠ করা হবে দলীয় উদ্যোগে। সেই একলাখের মধ্যে কুড়ি হাজার লোক নিয়ে উত্তর পশ্চিম দিল্লিতে পদযাত্রা করতে পারতেন, দিল্লি পুলিশ কার্যালয়ে প্রতিবাদ তো জানাতে পারতেন। কিন্তু তা করেননি। প্রতিবাদ করেছে লোকসভা ও বিধানসভায় শূন্য পাওয়া কংগ্রেস দল।
আচ্ছা, বাংলার সংখ্যালঘুরাও তো তৃণমূলকে প্রাণ খুলে ভোট দিয়েছে। তারাও কি একইরকম বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হবেন?
আরও পড়ুনঃ ইস্টার্ন জোনাল কাউন্সিলের বৈঠকে মুখোমুখি অমিত শাহ- মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
-সংগঠনহীন, নেতাহীন তৃণমূল ও মিডিয়াসর্বস্ব বঙ্গ বিজেপি এখন কোনও রাখঢাক না করেই উগ্র সাম্প্রদায়িক বক্তব্য রেখে যাচ্ছে। ওরা জানে, দিদি থাকতে ওরা গ্রেফতার হবে না। কারণ, তৃণমূলের প্রাণভোমরা ওদের হাতের মুঠোয়। তাই ওদের চাই দিল্লির মতোই কোনও বিধ্বংসী ঘটনা, যাতে ভয়ঙ্কর মেরুকরণ হবে। দিদির প্রশাসন বাম- কংগ্রেসকে মিথ্যে কেসে ফাঁসিয়ে দাঁড়াতে দেবে না। দিদি শাসক আর বিজেপি বিরোধী দল হবে। দু’দলই নাগপুর ঘনিষ্ঠ। আর কি চাই? এটাই বোধহয়, মোদির কথায়- দোনো হাত মে লাড্ডু।
– ভোট এগিয়ে আসছে। সারদা ইস্যু আবার উঠবে। হয় বিজেপিকে পদক্ষেপ নিতে হবে অথবা দিদিকে রফায় আসতে হবে। সংখ্যালঘু ভাইবোনেরা, বাংলার শুভবুদ্ধিসম্পন্ন, কাটমানি না খাওয়া ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ কি তৃণমূলের মতো এমন ঝুলে থাকা দলকে ভরসা করবে? যারা নিজেদের বাঁচাতে ব্যস্ত, তারা কি আপনাদের সুরক্ষা দিতে পারবে????
দেশে আজ কংগ্রেস আর সংঘের বিচারধারার যুদ্ধ চলছে। তৃণমূল, মায়াবতী আর জয়ললিতার দল নিজেদের বাঁচাতে ঐক্যবদ্ধ বিরোধিতার বাড়া ভাতে ছাই দিচ্ছে। তাতেই লাভ হচ্ছে মোদির। পাচ্ছে ক্ষমতা। হচ্ছে উত্তর পশ্চিম দিল্লিতে গণহত্যা। দিদি চুপ। মায়াবতী চুপ।
ঘটনা দ্রুত বদলাচ্ছে। লড়াই আরও কঠিন হচ্ছে। কিন্তু কংগ্রেস আরও উজ্জ্বল হচ্ছে সংগ্রামের ধাপে ধাপে। কিন্তু যারা সত্যি লড়ছে তাদের সমর্থন না দিয়ে, যারা লড়াই লড়াই খেলা করছে তাদের সমর্থন দেওয়াটা কি উচিত? হয়তো ধ্বংসের আগুনের মধ্যে দাঁড়িয়ে কিছু লোক আজ এই অনুতাপ করছে।
বাংলার মানুষ কি দিল্লির থেকে শিখবেন না? মনে রাখবেন, ভোট ভাগের খেলায় বাংলায় বিজেপি আছে বলেই তৃণমূল ক্ষমতায় আছে। তৃণমূল ক্ষমতায় আছে বলেই বাংলায় আরএসএস-এর শাখা বাড়ছে।
কথাটা কি ভুল বললাম?
(প্রতিবেদনে উপস্থিত প্রতিটি শব্দের দায় প্রতিবেদকের নিজের।)