বন্ধ বিধায়ক তহবিলের বরাদ্দ অর্থ, ক্ষোভ বাড়ছে দলের অন্দরে
সহেলী চক্রবর্তী
অর্থনৈতিক অবরোধ নাকি রাজনৈতিক প্রতিরোধ? আপাতত এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন বাংলার মানুষ। যদি একটু অন্যভাবে বলা যায়, তাহলে করোনা ও আমফান পরিস্থিতি কী অর্থনীতিতে অবরোধ বা প্রতিরোধ গড়ে দিয়েছে?
পশ্চিমবঙ্গের ৬ কোটি ভোটারের মাথায় এখন এই প্রশ্ন দুটোই ঘুরপাক খাচ্ছে। বিষয়টি স্বাভাবিকই বটে। সৌজন্যে বঙ্গ রাজনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপট।
জনগণের ভোটে নির্বাচিত জন প্রতিনিধি নিজ এলাকায় উন্নয়নে জোর দেবেন এটাই কাম্য। অর্থাৎ পানীয় জল থেকে রাস্তাঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে স্ট্রিট লাইট সহ এলাকার বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর সচেতন ভূমিকা অবশ্য কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। এই সমস্ত কাজগুলিই সংগঠিত হয় বিধায়ক তহবিলের টাকা থেকে।
বিধানচন্দ্র রায় থেকে অজয় মুখার্জী, সিদ্ধার্থ শংকর রায় থেকে জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শাসকের চেয়ারে যে যখন বসেছেন এই বিধায়ক তহবিলের টাকা জনস্বার্থে বিভিন্ন ভাবে নির্ণয় করেছেন। ধাপে ধাপে বিধায়কদের আর্থিক প্রগতির সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে অর্থ বরাদ্দের পরিমাণ।
এই রাজ্যে বিভিন্ন সময়ে অর্থনৈতিক প্রতিরোধ এসেছে, কিন্তু কখনই বিধায়ক তহবিলের অর্থ বন্ধ হয়ে যায়নি। তবে এতদিন না ঘটলেও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমানায় ঘটল সেই নজির বিহীন ঘটনাও।
চলতি বছরে করোনা ও আমফান ঘায়ে বিধ্বস্ত গোটা বিশ্বের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গ। রাজ্যের ভাঁড়ার প্রায় শূণ্য। বারবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলতে শোনা গিয়েছে “নো আর্নিং, অনলি বার্নিং”।
তাই একপ্রকার বাধ্য হয়েই চলতি বছরের এপ্রিল মাস থেকে বন্ধ রয়েছে বিধায়ক তহবিলের টাকা। প্রতিটি জেলার জেলাশাসককে নবান্নের তরফে ইমেল মারফৎ স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হয়েছে অর্থমন্ত্রকের পরবর্তী পদক্ষেপ না জানানো পর্যন্ত বিধায়ক তহবিলের টাকা দেওয়া যাবে না।
সরকারের এহেন নির্দেশে চরম বিরম্বনায় পড়েছে শাসক ও বিরোধী দলের বিধায়করা। কারণ এলাকার উন্নতিকল্পে ব্যাঘাত ঘটলেই তৈরী হচ্ছে জনরোষ। সামনেই ২০২১ এর মহারণ। গদি বাঁচানোই কার্যত চ্যালেঞ্জ হয়ে যাবে যে!
শাসক বনাম বিরোধী তরজা করোনা-আমফান পরিস্থিতিতেও তুঙ্গে ছিল। আর শাসকদলের বিধায়ক তহবিলের অর্থ বন্ধের নির্দেশ যে তাতে ঘৃতাহুতি দিয়েছে তা নিঃসন্দেহে স্পষ্ট।
এবিষয়ে বাঁকুড়ার সোনামুখীর সিপিএম বিধায়ক অজিত রায়ের কথায়, এই সরকার মেলা-খেলা-পুজোয় ও আনুষাঙ্গিক এত খরচ করেছে যে জনস্বার্থে বিধায়ক তহবিলের টাকা দিতে পারছে না। শুধু তাই নয় রাজ্য সরকারকে তোপ দেগে তিনি বলেন, “প্রশান্ত কিশোরকে ৪০০ কোটি টাকা দিতে হবে।সেটাও একটা কারণ। পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে রাজ্যসরকারের কোন উদ্যোগ দেখা গেল না সেইভাবে। আমরাও ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকাকালীন অনেক অর্থনৈতিক প্রতিকূলতা কাটিয়েছি। কিন্তু এই স্বৈরচারী সরকারের আমলে যা হল তা পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে প্রথমবার।”
একই সুরে সুর মিলিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক তৃণমূল বিধায়কও। তাঁর কথায়, “সমস্যা রয়েছে তা আমরা জানি। কিন্তু সামনেই বিধানসভা নির্বাচন। উন্নয়ন থমকে গেলে জনগণ প্রশ্ন করবেনই। পাশাপাশি গ্রামের দিকে এখনও বেশ কিছু অঞ্চলে গোষ্ঠী কোন্দল রয়েছে। সেক্ষেত্রে গ্রামের বিধায়করা বেশ চাপে রয়েছেন”।
বিষ্ণুপুরের বিজেপি বিধায়ক তুষারকান্তি ভট্টাচার্যের কথায়, শাসকদলের এই সিদ্ধান্ত সব বিধায়কদের বিপাকে ফেলবে। যদি বিধানসভা খোলা থাকত তাহলে এর বিরোধীতা করা সম্ভব হত। এখন চুপ করে থাকা ছাড়া উপায় নেই।
মাদারিহাটের বিজেপি বিধায়ক মনোজ টিগ্গার কথায়, সরকারের এই সিদ্ধান্তে জনপ্রতিনিধিরা জনগণকে দেওয়া আশ্বাস পূরণে ব্যর্থ হবে। আমার মতে এই টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা অবিলম্বে করা উচিৎ।
শাসকদলের তরফে সাফাই, কেন্দ্র সরকারের কাছ থেকে প্রাপ্য টাকা এখনও মেলেনি। তারউপর রয়েছে ঋণের বোঝা। একপ্রকার বাধ্য হয়ে তাই বিধায়ক তহবিলের টাকা বন্ধ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, আমফান পরবর্তী পরিস্থিতিতে ত্রাণ বন্টন ও রেশন ব্যবস্থা নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে দফায় দফায় দুর্নীতির অভিযোগে সরব হচ্ছেন বিরোধীরা।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, বিধায়ক তহবিলের বরাদ্দ অর্থ বন্ধ রাজনীতির একটি অংশ। সরকারের এই সিদ্ধান্তের প্রতিফলন ঘটবে আগামী ভোটবাক্সে। গদি বাঁচাতে পারবেন তো সরকার বাহাদুর?