নারী তুমি অনন্যাঃ কলমে অপরাজিতা ঘোষ

৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারীদিবস। সমাজ বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গিয়েছে নারী দিবসের সংজ্ঞাও। আজও পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী হেনস্থার শিকার। কোনো ক্ষেত্রে নিজের বাড়িতেও সুরক্ষিত নন তাঁরা। শুধুমাত্র বিভিন্ন রকম উদ্যোগ ও সেলিব্রেশনের মধ্যে দিয়েই বছরের পর বছর পালিত হয়ে আসছে আন্তর্জাতিক নারীদিবস।

আমরা কথা বলেছিলাম সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে। কীভাবে ব্যাখ্যা করছেন তাঁরা আন্তর্জাতিক নারীদিবস দিনটি, এই বিশেষ প্রতিবেদনে তুলে ধরা হল সেই সব দৃষ্টিভঙ্গি।

অপরাজিতা ঘোষ, পরিচালক ও অভিনেত্রী

আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। বর্তমান সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে এই দিনটি আলাদা করে পালন করার কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে কী?

যেকোনো সেলিব্রেশন আমার কাছে খুব পছন্দের। কারণ সেলিব্রেশনের মাধ্যমে অনেক কিছু পরিবর্তন সম্ভব।তবে মাথায় রাখতে হবে সেলিব্রেশন যেন শুধু যেন উৎসবে আটকে না থাকে। কারণ সেলিব্রেশনের মাধ্যমে শপথ নিতে হবে। সারাবছর অসম্মান করব, আর একটা দিন সেলিব্রেট করব..আমি ব্যাক্তিগত ভাবে মনে করি তার কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। প্রত্যোকটা দিনই নারী দিবস। আজ কোনো আলাদা দিন নয়।

আমাদের ছোটবেলায় আমরা দেখেছি আমাদের মেয়ে বলে অনেকরকম বিধিনিষেধ মেনে চলত হত? আপনর ক্ষেত্রেও কী সেরকম কোনো পরিস্থিতি ছিল? নাকি ছেলে মেয়ে সমান সমান ভাবে বড় হয়েছেন?

আমার পরিবার খুব উদার মানসিকতার। আমরা দুই বোন। তবে কোনোদিন মেয়ে বলে আলাদা কোনো বিধিনিষেধ ছিল না। হ্যাঁ বেশী রাতে ফিরলে নেহাত চিন্তা থেকে মা-বাবা বকত। আমরা খুব ডিসিপ্লিনড ভাবে বড় হয়েছি। তার জন্যই পরবর্তীকালে যখন জেন্ডার ডিভিশন দেখেছি তখন মানিয়ে নিতে খুব অসুবিধা হয়েছে।

রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় এবং মালদার স্কুলের ছাত্রীদের রবীন্দ্র সঙ্গীত বিকৃত করতে দেখা গিয়েছে। তাতে সমাজের একটি অংশ বলছে অতিরিক্ত নারী স্বাধীনতাই এর কারণ। আবার অনেকেই বলছেন এই ঘটনা মেয়েদের অনেকটাই সমাজের চোখে পিছিয়ে দিল?

প্রথমেই বলি রবীন্দ্রনাথের উপর কোনো কিছু আছে বলে আমি মনে করিনা। আর এখানে ছেলে না মেয়ে কোনো ম্যাটার করে না।বিষয় টা হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে অপমান করা। এই ঘটনা আসলে শিক্ষা, সংস্কৃতি নিয়ে প্রশ্ন তোলে। খারাপ উদাহরণ দিয়ে সমাজকে চিহ্নিত করা যায় না। যদি মেয়ে বলে বেশী হাইলাইটেড হয়, তাহলে বিষয়টা খুব খারাপ।

আর সমাজের একটা অংশ অনেক কিছুই বলে। কিন্তু তারা যদি সমাজ পরিবর্তন নিয়ে যদি কোনো কাজ করত সেটা ভাল হত।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বাধা বিপত্তি পেরিয়ে এখন অনেক এগিয়ে এসেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আজও যদি কোনো মেয়ে দেরি করে বাড়ি ফেরে পাড়া প্রতিবেশীর বাঁকা দৃষ্টির শিকার হতে হয় তাঁকে। কীভাবে দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো সম্ভব? পরিবারের ভূমিকা কেমন হওয়া প্রয়োজন?

Everything starts from the family…. সবসময় মনে রাখতে হবে পরিবারে মায়ের ভূমিকা সবথেকে বেশি। কারণ তিনি ছেলেকেও মানুষ করছেন, মেয়েকেও মানুষ করছেন। তাঁকেই সেই জায়গাটা ছেলেদের মনে তৈরী করতে হবে যে তুমি যতটা সম্মান আমাকে দিচ্ছ, বোনকে দিচ্ছ, ততটাই অন্য মেয়েদেরও দিতে হবে। বাড়ি থেকে এই শিক্ষা যত দেওয়া হবে আস্তে আস্তে সমাজ পরিবর্তন হতে বাধ্য।

পরিবার নিয়েই সমাজ তৈরী হয়। একটা গুরুত্বপূর্ন বিষয় হচ্ছে, সমাজে এই ধরণের ঘটনা ঘটলে প্রতিবাদ করতে হবে। এমনকি ছোটদেরও শেখাতে হবে কোথায় প্রতিবাদটা করা য়ায। বাবা মায়ের জন্য এটা বোধহয় খুব কঠিন কাজ নয়।

অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় মহিলারা মহিলাদের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এক্ষেত্রে মহিলাদের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হওয়া প্রয়োজন?

এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আমি অত্যাচারিত হয়েছি বলেই অন্যকে অত্যাচারিত হতে হবে তার কিন্তু কোনো মানে নেই। আমি খুশী না বলে অন্যকে খুশী হতে দেব না, এটা কখনো হতে পারেন। আমার জীবনে যা খুশী হোক, তাই বলে অন্যের জীবনে সেটা কখনই হতে দেওয়া উচিত না। এটা কেমন মানসিকতা আমি বুঝতে পারিনা। দুঃখজনক হলেও এটা হয়েই চলেছে। আমার চেনা পরিচিত অনেকেই এই ঘটনার শিকার। একজন মেয়ের দায়িত্ব অন্য একজন মেয়ে কে রক্ষা করা।

এই ধরণের ঘটনা যত ঘটছে আমরা ততই নীচে নেমে যাচ্ছি। এটা নিজেদেরই থামাতে হবে। এটা ভাঙা প্রয়োজন।

বর্তমানে টিভি সিরিয়াল গুলিতে মহিলাদের চরিত্র যেভাবে দেখানো হয়, সেটা সমাজের বুকে কতটা এফেক্টিভ?

সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে মিডিয়ার রোল ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। সবসময় শুনি পাবলিক এটা খায়, বা সমাজে এটা হচ্ছে তাই দেখানো হচ্ছে। খুব দুঃখ হয় যখন দেখি যাদের হাতে সমাজ পরিবর্তনের দায়িত্ব তাদের কলম থেকে এই ধরণের লেখা বেরোয়। আমি ইন্ডাস্ট্রির অংশ হয়েও এটা বলছি। আমি জানি না কোন জায়গা থেকে এগুলো আসে। কেন আমরা মেয়েদের লড়াইটা হাইলাইট করে দেখাতে পারি না। আমাদের এই দায়িত্বটা পালন করার দিন এসে গেছে।

নারী দিবসের আগেই প্রতিবারই একটা করো নারী কেন্দ্রিক সিনেমা রিলিজ করে। এমন সিনেমা আগেও হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে সেই ইমপ্লিমেন্ট কতটা হচ্ছে বলে মনে করেন?

এমন রিয়েল লাইফ স্টোরি অনেক আছে। হয়ত এমনও আছে আমরা যাদের খোঁজ রাখিনা। কোনো কোনো সময়ে খবরের কাগজে একচিলতে জায়গায় সেটা দেখতে পাই। এমন বহু মানুষ আছেন যারা প্রতিনিয়ত লড়ছেন, জিতছেন। অন্যকে সহযোগীতা করছেন। তাদের নিয়ে সিনেমা হোক বা না হোক, তারা আছেন বলেই আমরা সমাজে মাথা উঁচু করে বেঁচে আছি। লড়াই করার সাহস পাচ্ছি।

সিনেমার গল্প থেকে বাস্তব জীবনের লড়াই অনেক বেশী ইমপ্যাক্ট ফেলে। তাই সেই লড়াই অনেক অনেক বেশী প্রেরণা জোগায়।

সম্পর্কিত পোস্ট