এ কোন ঐতিহাসিক গতিপথ?

শুভজিৎ চক্রবর্তী

ভার্চুয়াল দুনিয়ায় বেশকিছু ট্রেন্ডিং শব্দের সঙ্গে বাস্তবে লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে আমাদের সকলকে। ঠিক এরই মধ্যে রয়েছে সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং, লকডাউন, কোয়ারেন্টাইন। এই শব্দগুলোর সূত্রপাত চিনের উহান প্রদেশ থেকে আগত কোভিড-১৯ ভাইরাসের হাত ধরেই।

কিন্তু বিগত এক দশক ধরে আর একটি বাস্তবিক সমস্যার সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে। তা হল বেকারত্ব। বেকারত্বের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে দেশের বৃহৎ অংশের যুবসমাজ সরাসরি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দিকে।

কখনও চাকরী পরীক্ষার জন্য টুইটারে ট্রেন্ডিং কখনও প্রধানমন্ত্রীর ‘মন কি বাত’-এ হুড়হুড় করে ডিসলাইক দিয়ে মহামারিতেও একটা ভার্চুয়াল আন্দোলন জারি রেখেছে।

লড়াইটা আরও কঠিন হয়ে পড়েছে যখন দেশের জিডিপি একেবারে তলানিতে ঠেকে গিয়েছে। বিশ্বের জি-২০ অন্তর্ভুক্ত শক্তিশালী দেশগুলির মধ্যে ভারতের রেজাল্ট সবচেয়ে খারাপ। চলতি আর্থিক বর্ষের প্রথম ত্রৈমাসিক অর্থাৎ এপ্রিল থেকে জুন অবধি ভারতের জিডিপির হার -২৩.৯।

অর্থাৎ অর্থনৈতিক প্রগতির পরিবর্তে সংকোচন হয়েছে। যার সরাসরি প্রভাব পড়তে চলেছে। ট্রেন্ডিং এবং নন ট্রেন্ডিং এর গুতাগুতিতে এই আন্দোলনের প্রভাব কতটা পড়তে চলেছে, সেটার জন্য দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে চোখ বোলানো দরকার।

সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন এবং এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাঙ্কের রিপোর্ট অনুযায়ী গোটা দেশে লকডাউনের কারণে বিভিন্ন সেক্টরে ৪১ লক্ষ যুবক কাজ হারিয়েছেন। চলতি বছরের শেষে এই সংখ্যা ৬১ লক্ষ গিয়ে দাঁড়াতে পারে বলে জানাচ্ছে এই রিপোর্ট।

ম্যাকেন্সি গ্লোবাল রিপোর্টে বলা হচ্ছে এই ঘাটতি পুরণ করতে আগামী এক দশকে প্রায় ৯ কোটি নিয়োগ করতে হবে সরকারকে।

গত মাসে সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমির রিপোর্টে বলা হয়েছিল

  • লকডাউন পর্বে সংগঠিত সেক্টরে প্রায় ১.৮৯ কোটি ভারতীয় চাকরী হারিয়েছেন।
  • শুধুমাত্র জুলাই মাসে ৫০ লক্ষ মানুষ কাজ হারিয়েছেন।
  • সিএমআইইর রিপোর্ট অনুযায়ী, এপ্রিল মাসে দেশে বেকারত্বের হার ছিল ২৩.৫২ শতাংশ ।
  • মে মাসে ২৩.৪৮ শতাংশ।
  • জুন মাসে ১০.৯৯ শতাংশ।
  • জুলাই মাসে ৭.৪৩ শতাংশ এবং
  • অগাস্টে ফের বেকারত্বের হার বেড়ে দাঁড়ায় ৮.৩৫ শতাংশে।

শহরাঞ্চলে অসংগঠিত সেক্টরে কর্মরত বহু মানুষ নিজেদের কাজ হারিয়ে গ্রামে ফেরার জন্যই লকডাউনের প্রথম মাসে বৃহৎ অংশের মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েন। শহরাঞ্চলে কাজ বন্ধ হয়ে পড়ায় পিঁপড়ের সমান সংখ্যক মানুষ গ্রামে ফিরে যান।

পরে মহাত্মা গান্ধী ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট অ্যাক্ট অথবা মনরেগার আওতায় বহু মানুষ তাদের রুজিরুটির সন্ধান খুঁজে পায়।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের তথ্য অনুযায়ী,

  • গত বছর মনরেগার আওতায় কর্মরত মানুষের সংখ্যা ছিল ৭.৭২ লক্ষ৷ চলতি বছরে তা ২১.০৯ শতাংশে উপস্থিত হয়
  • চলতি বছরে উত্তরপ্রদেশে মনরেগার আওতায় একশো দিনের কাজ পেয়েছেন ২১.০৯ লক্ষ মানুষ। যা গোটা দেশের মধ্যে সর্বাধিক।
  • এছাড়াও বিহারে ১১.২২ লক্ষ,
  • পশ্চিমবঙ্গে ৬.৮২ লক্ষ,
  • রাজস্থানে ৬.৫৮ লক্ষ  এবং
  • মধ্যপ্রদেশে ৫.৫৬ লক্ষ মানুষ মনরেগার সুবিধা পেয়ে নিজেদের রুটি রুজি জুগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছেন।
  • গোটা দেশে নতুন করে জব কার্ডের জন্য আবেদন করেছেন ৬৪.৭০ লক্ষ মানুষ।
  • গ্রামীন ভারতে এই সংখ্যা স্বস্তি দায়ক হলেও শহরাঞ্চলে বেকারত্বের পরিসংখ্যান বেশ চিন্তার কারণ।

সিএমআইই এর রিপোর্ট অনুযায়ী সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে গোটা দেশের মধ্যে সর্বাধিক বেকারত্বের হার

  • সিএমআইই এর রিপোট বলছে, চলতি বছরের জুলাই মাসে ভারতে শহরাঞ্চলে বেকারত্বের হার ছিল ৯.১৫ শতাংশ।
  • অগাস্ট মাসে তা বেড়ে হয় ৯.৮৩ শতাংশ।
  • হরিয়ানায় (৩৩.৫ শতাংশ)।
  • দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ত্রিপুরা(২৭.৯ শতাংশ),
  • তৃতীয় রাজস্থান (১৭.৫ শতাংশ),
  • চতুর্থ গোয়া (১৬.২ শতাংশ)
  • পঞ্চম হিমাচল প্রদেশ (১৫.৮ শতাংশ)।

বেকারত্বের হারে পিছিয়ে নেই পশ্চিমবঙ্গ। রাজ্যে বেকারত্বের হার ১৪.৯ শতাংশ। রাজ্যে বেকারত্বের ছবিটা আরও স্পষ্ট হয় যখন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের ২১ শে জুলাইয়ের ভার্চুয়াল র‍্যালিতে কমেন্টবক্স মুষলধারে চাকরী প্রার্থীদের কমেন্টে ভরে যায়।

বেকারত্বের হারে সবথেকে পিছিয়ে রয়েছে কর্ণাটক। এই রাজ্যে বেকারত্বের হার ০.৫ শতাংশ।

সেখানে এসএসসি,প্রাইমারি এবং আপার প্রাইমারি চাকরি প্রার্থীদের আবেদন এবং পার্শ্বশিক্ষকদের কমেন্টে ভরে যায়। করোনার কারণে পাল্টে যাওয়া জীবনের মধ্যে এটাও পরিবর্তিত আন্দোলন।

http://sh103.global.temp.domains/~lyricsin/thequiry/pranab-mukherjee-recites-chandis-verses-in-parliament-full-of-treasury-benches/

যাকে গুরুত্বহীন হিসাবে দেখছে সরকার৷ তবে দেশের অর্থনৈতিক মন্দা এবং বেকারত্বের পিছনে মহামারী থাকলেও সরকারি গাফিলতি রয়েছে।

এই ইস্যুতে সরব হয়েছে বিরোধীরা। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী দেশজুড়ে বেকারত্ব নিয়ে একের পর এক ভিডিও প্রকাশ করে চলেছেন।

মহামারীতেও চাকরীর আবেদন জানিয়ে পথে নামছে বাম সংগঠনগুলি। সেই জায়গায় রাজ্য সরকারগুলির পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হলেও, কোমড় ভাঙা অর্থনীতি এবং বেকারত্ব ইস্যুতে চুপ রয়েছে কেন্দ্র সরকারের একাধিক মন্ত্রী। বরং এই মহামারিতেও ঘুষ নিয়ে চাকরি দেওয়া এবং মনরেগাতে স্বজনপোষণের অভিযোগ উঠেছে সরকারের বিরুদ্ধে।

আনলক পর্বের মাধ্যমে ধীরে ধীরে বেকারত্বের সমস্যা দুর হতে পারে এবং শুয়ে পড়া অর্থনীতি চাঙা হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। অনেকের মতে যে সমস্ত শ্রমিকরা শহরাঞ্চলে কাজ না পেয়ে গ্রামে ফিরে গেছেন কিন্তু কোভিডের ভয়ে অনেকেই ফিরে আসতে চাইছেন না।

অনেকেই একটানা আর্থিক দুর্দশা থেকে মুক্তি পেতে ফের শহরে ফিরে গেলেও নতুন করে কাজের সন্ধান পাচ্ছেন না। বিহারে যে সমস্ত শ্রমিক লকডাউনের কারণে গ্রামে ফিরে গিয়েছিলেন তাঁদের অনেকেই করোনা বিপদের মাঝেই ফিরে গিয়েছেন কাজে। কিন্তু সেখানেও সুরাহা কিছু হয়নি।

অভিযোগ, বিহারের নীতিশ কুমারের সরকার মনরেগার আওতায় খুব কম সংখ্যক মানুষকে রোজগার দিয়েছেন। তাই বেশীরভাগ মানুষকেই ফিরে যেতে হয়েছে কাজে। কিন্তু সেখানেও লকডাউনের কারণে কাজ না থাকায় এখন তাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত।

দেশের একাধিক রাজ্যে বেকারত্বের কারণে বহু মানুষ আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছেন। সম্প্রতি ব্যাঙ্গালুরুর দাঙ্গায় পুলিশের রিপোর্টে বলা হয় সেখানে বেকারত্বের সংখ্যা বেশী থাকায় বহু মানুষ হিংসার ঘটনায় লিপ্ত হন।

অন্যদিকে সরকার চাকরী প্রার্থীদের জন্য কমন এলিজিবেল টেস্টের ব্যবস্থা করেছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকর সাংবাদিক বৈঠকে বলেন, চাকরীর জন্য আবেদনকারীদের একাধিক পরীক্ষার বোঝা লাঘব করতে সরকার ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নিয়েছে।

প্রকাশ জাভড়েকরের কথায় এই সিদ্ধান্ত ঐতিহাসিক। কিন্তু গত কয়েকমাসে দেশে বেকারত্বের হার নতুন করে ইতিহাস গড়তে চলেছে। শহর থেকে কাজ হারিয়ে শ্রমিকের কাজ করছেন, আবার কাউকে ক্ষেতের জমিতে চাষ করে কাটিয়ে দিতে হচ্ছে।

গত মাসে জিডিপি পরিসংখ্যান অনুযায়ী উৎপাদন শিল্পে ২৩.৩ শতাংশ সংকোচন, নির্মাণ শিল্পে ৫০ শতাংশ সংকোচন এবং পরিবহন ক্ষেত্রে জিডিপি ৪৭ শতাংশ সংকোচিত হলেও কৃষিক্ষেত্রে ভারতের বৃদ্ধি হয়েছে ৩.৪ শতাংশ।

অর্থাৎ লকডাউনের মতো কঠিন সময়ে দেশের কৃষি শুধুমাত্র মানুষের মুখে আহার জোগায়নি, বরং আর্থিক পরিকাঠামো ধরে রাখতে সাহায্য করেছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে এই মুহুর্তে সংগঠিত সেক্টরগুলিতে বিপুল সংখ্যক নিয়োগ করতে হবে সরকারকে। এর ফলে অসংগঠিত সেক্টরগুলি ক্রমাগত চাঙা হতে শুরু করবে।

তাতে ভারতের অর্থনীতিতে বদল আসতে পারে। আবার একাংশের মতে, দেশের এই কঠিন অবস্থা কাটিয়ে উঠতে অনেকটা সময় লেগে যাবে।

এখন প্রশ্ন হল, নিজেদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষার জন্য যুবকদের আরও দীর্ঘ সময়ের জন্য লড়াইকে অতিবাহিত করতে হবে? নাকি ব্যাপক সংখ্যক ডিসলাইকের জেরবার হয়ে কোনও পদক্ষেপও নেবে নয়া দিল্লি। নির্বাচনের আগে ফের কোনও জাতীয় ইস্যুতে প্রভাবিত হবে না তো যুবসমাজ? ভার্চুয়ালের পাশাপাশি বাস্তব দুনিয়াতেও কঠিন প্রশ্নের শরণাপন্ন দেশ।

সম্পর্কিত পোস্ট