পাহাড়ের রাজনীতিতে তৃণমূলের টেক্কা হতে চলেছেন বিনয় তামাং?

দ্য কোয়ারি ওয়েবডেস্কঃ দার্জিলিং পাহাড় একসময় বামেদের শক্ত ঘাঁটি ছিল। স্বাধীনতার আগে জ্যোতি বসুর পাশাপাশি এই বাংলার পাহাড়ের প্রতিনিধি রতনলাল ব্রাহ্মণ বঙ্গ আইনসভার নির্বাচিত কমিউনিস্ট সদস্য ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও পাহাড়ে কমিউনিস্টদের সেই প্রভাব বজায় থাকে। কিন্তু সুবাস ঘিসিং নামে সেনাবাহিনীর এক অবসরপ্রাপ্ত হাবিলদার সব হিসেব গোলমাল করে দেন।

দার্জিলিং পাহাড়ে গোর্খা জাতিসত্তার রাজনীতি এই সুবাস ঘিসিংয়ের হাত ধরেই শুরু হয়েছিল। তাঁর তৈরি জিএন‌এল‌এফের উত্থানে পাহাড়ে বামেদের দাপট শেষ হয়ে যায়। এমনকি পৃথক রাজ্যের দাবিকে প্রাধান্য দিয়ে সিপিএম ভেঙে তৈরি হয় সিপিআরএম। এরপর দীর্ঘ তিন দশক দার্জিলিং পাহাড় মানেই ছিল সুবাস ঘিসিং।

পৃথক রাজ্যের দাবি আদায় করতে না পারলেও লালকুঠিতে বসে দিব্যি নিজের দাপট বজায় রেখেছিলেন ছোটোখাটো চেহারার ঘিসিং। কিন্তু তাঁর‌ই ঘনিষ্ঠ অনুগামী বিমল গুরুংয়ের হাত ধরে পাহাড়ের রাজনীতির ব্যাটন বদল হয়।

গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা তৈরি করে এক দশকেরও বেশি সময় পাহাড়ে একচেটিয়া রাজত্ব চালান গুরুং। ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটের আগে জঙ্গলমহলের পাশাপাশি উত্তরবঙ্গকে অশান্ত করার পিছনে বিমল গুরুংয়ের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল। বামেরা সেই সময় অভিযোগ করেছিল তলায় তলায় বিমল গুরুংকে মদত যোগাচ্ছে তৃণমূল।

সেই নির্বাচনেই দীর্ঘ ৩৪ বছরের বাম জামানাকে ক্ষমতাচ্যুত করে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি সিপিএমের উল্টো পথে হেঁটে পাহাড়ে তৃণমূলের সংগঠন মজবুত করার চেষ্টা করেন। যদিও তার ফল হয় হিতে বিপরীত। ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন গুরুং। তিনি পাহাড়ে তীব্র রাজ্য সরকার বিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। রাজ্যের যাবতীয় কর বয়কটের ডাক দেন। যাকে বলে একেবারে অসহযোগ আন্দোলন।

ক্ষমতা দখলের আগে প্রয়োজন মজবুত সংগঠন, ত্রিপুরায় ‘রাজীব’ ভরসা অভিষেকের

এই পর্বে সম্পূর্ণ বিজেপির দিকে ঢলে পড়েন বিমল গুরুং। তাঁর সমর্থন পেয়েই প্রথমে যশোবন্ত সিং, পরে সুরিন্দর সিং আলুওয়ালিয়া দার্জিলিং থেকে বিজেপি সাংসদ হিসেবে নির্বাচিত হন। এমনকি ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে পলাতক গুরুং সমর্থন করায় দার্জিলিং আসনটি দখল রাখতে সক্ষম হয় বিজেপি। সাংসদ হিসেবে নির্বাচিত হন রাজু বিস্তা।

ইতিমধ্যেই রাষ্ট্রদ্রোহ সহ একাধিক অভিযোগে বিমল গুরুংকে প্যাঁচে ফেলে রাজ্য সরকার। সিকিম পালানোর সময় গুরুং বাহিনীর হাতে অমিতাভ মালিক নামে রাজ্য পুলিশের এক এএসআই খুন হন বলে অভিযোগ ওঠে। এরপর অন্তরালে চলে যেতে বাধ্য হন বিমল গুরুং।

এরপরই গোর্খা জনমুক্তি মোর্চায় ভাঙন ধরে। দলের রাস হাতে নেওয়ার চেষ্টা করে বিনয় তামাং-অনীত থাপা জুটি। তাঁরা বিজেপির পাশ থেকে সরে এসে তৃণমূলকে সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু দার্জিলিং পাহাড়ে তৃণমূল যে কত ভঙ্গুর তা লোকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচনে প্রমাণ হয়ে যায়। শত চেষ্টা সত্ত্বেও তারা পাহাড়ে দাগ কাটতে পারেনি।

এদিকে একুশের বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক আগে সম্পূর্ণ ভোল বদল ঘটে বিমল গুরুংয়ের। তিনি অন্তরাল থেকে বেরিয়ে এসে বিজেপির বিরুদ্ধে একগুচ্ছ অভিযোগ তুলে তৃণমূলকে সমর্থনের কথা ঘোষণা করেন। পাল্টা বিজেপির পাশে এসে দাঁড়ায় জিএন‌এল‌এফ। কার্যত গুরুংয়ের হাত ধরেই পাহাড়ে সামান্য হলেও নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেয় তৃণমূল।

এদিকে বিধানসভা নির্বাচনের পর অনীত থাপার থেকে আলাদা হয়ে যান বিনয় তামাং। প্রায় আট মাস পর হঠাৎ করেই তিনি তৃণমূলে যোগদান করেন। তাৎপর্যপূর্ণভাবে কলকাতা থেকে শিলিগুড়িতে ফিরে তিনি জানান বিমল গুরুংয়ের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে পাহাড়ে তৃণমূলকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন! উল্লেখ্য, গুরুং সরাসরি তৃণমূলে যোগ দেননি। তবে তাঁর গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা এখন বাংলার শাসক দলের অন্যতম শরিক দল।

প্রশ্ন হচ্ছে পাহাড়ে যে তৃণমূলের ভিত্তি মজবুত নয়, যাদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব পুরোপুরিভাবে বিমল গুরুংয়ের মুখাপেক্ষী, সেই তৃণমূলে কেন যোগ দিলেন বিনয় তামাং? কেন তিনি সরাসরি গুরুংয়ের কাছে ফিরে গেলেন না?

এক্ষেত্রে একটা কথা মাথায় রাখতে হবে বিনয় তামাং মূলত নরমপন্থী নেতা বলেই পরিচিত। বিমল গুরুংয়ের মতো চরমপন্থী আন্দোলন করে গোটা পাহাড়কে নিয়ন্ত্রণে আনা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া গুরুংয়ের বিরোধিতা করে বেশ কয়েক বছর পাহাড়ের রাজনীতিতে নিজের জায়গা করে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাতে সফল হননি।

সম্ভবত নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতেই তিনি শাসক দলে যোগ দিয়েছেন। আর তৃণমূলে যোগ দিয়েই তাৎপর্যপূর্ণভাবে পৃথক রাজ্যের দাবি ত্যাগ করেছেন বিনয়। তাঁর মুখে এখন গোর্খা জাতির সামগ্রিক উন্নয়নের কথা।

প্রশ্ন উঠছে বিনয় তামাংয়ের বিশেষ প্রভাব নেই পাহাড়ের রাজনীতিতে, তা জানা সত্বেও তৃণমূল কেন তাঁকে দলে নিতে আগ্রহী হল? সম্ভবত বিমল গুরুংয়ের উপর সম্পূর্ণ আস্থা না থাকাতেই তাঁর ‘অ্যান্টিডোট’ হিসেবে বিনয় তামাংকে দলে নেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য অতীতে ভোল বদলের নজির আছে বিমল গুরুংয়ের।

তাছাড়া তিনি যে কোনও মুহূর্তে তৃণমূলের সঙ্গে তিনি ‘ব্ল্যাকমেলের’ রাজনীতি করতে পারেন। তাই পাহাড়ে গুরুংয়ের আধিপত্য খর্ব করার জন্যই বিনয় তামাং কে দলে নিয়ে থাকতে পারে তৃণমূল। কারণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তথা তৃণমূলের লক্ষ্য হল পাহাড়ে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করে পৃথক রাজ্যের দাবি চিরস্তরে নির্মূল করে দেওয়া।

প্রশ্ন হচ্ছে গুরুংয়ের সমর্থন এবং বিনয় তামাংয়ের সরাসরি দলে অন্তর্ভুক্তির সুফল কী আদৌ পাবে তৃণমূল?

পুরসভা ও জিটিএ নির্বাচনের ক্ষেত্রে তারা অবশ্যই কিছুটা লাভবান হবে। কারণ অনীত থাপার সদ্য গঠিত দলও এই মুহূর্তে তৃণমূলের শরিক হিসেবে পরিচিত। তার উপর রাজ্যে ক্ষমতায় থাকার সুবাদে পুলিশ-প্রশাসনে তৃণমূলের নিয়ন্ত্রণ আছে। অপরদিকে বিজেপির সঙ্গে জিএন‌এল‌এফের টানাপোড়েন অব্যাহত। এই পরিস্থিতিতে তৃণমূল লাভবান হতেই পারে।

তবে আরেকটা আশঙ্কা আছে। নিজেদের দলের পুরোনো কর্মী, বিনয় তামাংয়ের অনুগামীরা, গুরুং শিবির, অনীত থাপা শিবির এতগুলি ভাগে বিভক্ত থাকায় নির্বাচনে প্রার্থী বাছাই করতে গিয়ে শাসক শিবিরে লড়াই বেঁধে যেতেই পারে। তবে পাহাড়ের রাজনীতি নিয়ে চূড়ান্ত কথা কখনোই আগেভাগে বলা উচিত নয়। গোটা বিষয়টি জানা বোঝার জন্য কিছুটা সময় আমাদের সকলকেই অপেক্ষা করতে হবে। এখন দেখা যাক কাঞ্চনজঙ্ঘার ছায়া দার্জিলিং পাহাড়ের কোন দিকে ঢলে পড়ে!

সম্পর্কিত পোস্ট