ফিনিক্স পাখির মতো উড়ে গেলেন, ত্রিপুরায় শেষ বামেদের ‘গৌতম’ অধ্যায়
নয়ন রায়
২০১৯ সালে ত্রিপুরায় গেছিলাম সাংবাদিকতার সূত্রে। ত্রিপুরায় আমার সহকর্মী সুদীপ নাথ প্রশ্ন করেছিল, দাদা গৌতম দাসের ইন্টারভিউ করবেন? তখন গৌতম দা ত্রিপুরা সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক। আমি আর না বলিনি।
সন্ধ্যার পর যখন পার্টি অফিসে পৌছলাম, দেখি একটা লম্বা ঘরে কাঠের চেয়ারে বসে তিনি অপেক্ষা করছেন আমার জন্য। একটু অবাকই হলাম। কারণ পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী নেতাদের সাক্ষাৎ পেতে আলিমুদ্দিনের বাইরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হত। এখানে সেটা ঘটেনি।
পরিচয় দিলাম নিজের এবং সংবাদমাধ্যমের। তারপরই গৌতম দা সাবলীল ভঙ্গিতে বললেন, “তোমার কি কি প্রশ্ন আছে শুরু করো।” একটু অবাক হলাম। প্রশ্ন করলাম গৌতম দা-কে।
রাজ্য থেকে আপনারা ক্ষমতাচ্যুত কেন হলেন? উত্তর পরিষ্কার। “মানুষ চাইনি তাই ক্ষমতাচ্যুত হয়েছি । তবে কমিউনিস্টরা বিভিন্ন সময় আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নিজেদেরকে প্রমাণ দিয়েছে। তাই এখন বিরোধী আসনে বসছি। ভবিষ্যতে কোথায় বসবো মানুষ ঠিক করে দেবে।”
কাট-কাট উত্তর। কোনো ভনিতা নেই । আরেকটা প্রশ্ন করব ভাবছিলাম। হঠাত গৌতম দা বললেন, “আপনি লেলিনের মূর্তি ভাঙ্গার কথা ভাবছেন?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম কি করে বুঝলেন? উত্তর, “আপনার চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে আপনি এই প্রশ্নটিই করতে চান। আসলে আমিও সাংবাদিকতা বিষয়টা জানি। আমি সাংবাদিক ছিলাম। আমার হাতে পার্টির পত্রিকার গুরু দায়িত্ব ছিল। তাই সাংবাদিকের ভাষা বুঝতে আমার কোনো অসুবিধা হয় না।”
জিজ্ঞাসা করলাম তাহলে কেন ভাঙলো মূর্তি? উত্তর- “অসভ্য একটা বর্বর দল লেনিনের মূর্তির গুরুত্ব বুঝবে না। তাই ওরা ভেঙেছে। যেমন তালিবানিরা বুদ্ধমূর্তি নষ্ট করেছিল আফগানিস্তানে। বিজেপি ত্রিপুরায় করে দেখালো। পার্থক্য শুধু রুচির।”
জিজ্ঞাসা করলাম, দাদা কমিউনিস্ট আন্দোলনে নতুন প্রজন্ম প্রভাবিত হচ্ছে না কেন? সোজাসাপ্টা জবাবে জানালেন, “এর জন্য দায়ী আমরাই। কারণ নেতাদের চালচলন, বৈভব, পার্টি বিচ্যুতি মনোভাব। তারা কমিউনিস্ট সুলভ আচার-আচরণ করছে না বলেই নতুন প্রজন্ম আমাদের ধারায় আসতে একটু ভয় পাচ্ছে। তবে এই ভয়টা কেটে যাবে একদিন। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কমিউনিস্ট আন্দোলনের ধারার পরিবর্তন ঘটছে তাই আসতেই হবে ওদের।”
কোনোরকম সঙ্কোচ না করেই সমস্ত প্রশ্নের জবাব ধৈর্য্য নিয়ে দিয়ে গেলেন। দেশের পরিস্থিতি, রাজ্যের পরিস্থিতি, আন্তর্জাতিক বাজার, ত্রিপুরার উপত্যকার পরিস্থিতি। সব মিলিয়ে সাক্ষাৎকারটি বেশ জমজমাট হল। উনি নিজেও খুব সন্তুষ্ট হয়েছিলেন।
ত্রিপুরা ছেড়ে আসার সময় বলেছিলাম, আপনার সঙ্গে আমার যোগাযোগ থাকবে। উত্তর দিয়েছিলেন, “সময় বলবে আপনি যোগাযোগ রাখবেন কি রাখবেন না।” আমি যোগাযোগ রেখেছি তাঁর সঙ্গে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত।
গোটা প্রতিবেদনে গৌতম দা আপনার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, অনেক বামপন্থী নেতাকে কাছ থেকে দেখেছি পেশার তাগিদে। তবে আপনার মত ছিমছাম, সাদামাটা, সর্বোপরি নিজেদের ভাল-মন্দ উভয় দিক অকপটে স্বীকার করা বাম নেতা আমি আগে দেখিনি। আজ আপনার মৃত্যুসংবাদে মন ভারী হয়ে গেছে। ত্রিপুরার রাজনৈতিক মাটিতে বামেরা আজীবন আপনার অভাব বোধ করবে।