লক্ষ্মীর ভাণ্ডার আসলে মমতার তৈরি মিথ, এতে উন্নয়নের নামগন্ধ নেই!

দ্য কোয়ারি ওয়েবডেস্ক-ঃ অর্থনীতির পরিভাষায় উন্নয়ন ও অগ্রসরতা নিয়ে নির্দিষ্ট সংজ্ঞা আছে। যেমন ধরুন রাস্তাঘাট, সেতু বিদ্যুৎ পরিষেবা ইত্যাদি নতুন করে জোর কদমে গড়ে তোলা হচ্ছে, অথবা আগে যে পরিকাঠামো ছিল তাকে আরও আধুনিক করা হচ্ছে এটিকে অর্থনীতির পরিভাষায় পরিকাঠামো উন্নয়ন বলে। আর এই নতুন পরিকাঠামো নির্মাণের ফলে দেশের যে আয় বা উপার্জন বাড়ছে তাই হল গ্রোথ বা অগ্রসরতা।
কিন্তু এই পরিকাঠামো উন্নয়ন ও গ্রোথের সুফল মানুষ পাচ্ছে কিনা তার উপরই ডেভলপমেন্ট নির্ভর করে। সহজ করে বললে দেশের যে আয় বাড়ছে তার সুফল জনসাধারণের কাছে পৌঁছেছে কিনা এবং তার দ্বারা মানুষের জীবনধারণের মানোন্নয়ন ঘটছে কিনা সেটাই ডেভলপমেন্ট বা উন্নয়নকে নির্ধারণ করে।
অর্থাৎ অর্থনীতির পরিভাষায় ডেভেলপমেন্ট গ্রোথের থেকে বেশ জটিল একটি বিষয়। এবার অর্থনীতির এই প্রেক্ষাপটে সহজ করে বুঝে নেওয়া যাক পশ্চিমবঙ্গের অবস্থাটা ঠিক কী।
২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচনের পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিভিন্ন প্রশাসনিক বৈঠকে বলতে শোনা গিয়েছে রাজ্যে উন্নয়নের কর্মযজ্ঞ জোরকদমে চলছে। মানুষের সব কাজ নাকি তাঁরা করে দিয়েছেন! এ ক্ষেত্রে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্পকে তিনি উন্নয়নের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে তুলে ধরেন। এই বিষয়ে স্পষ্ট বলা যায়, মুখ্যমন্ত্রী আসলে রাজ্যের মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন। কারণ আমজনতার পক্ষে বিষয়টি তলিয়ে দেখে এতো সহজে বোঝা সম্ভব নয়। সেই সুযোগই নিচ্ছেন তিনি।
প্রথম কথা উন্নয়নের যা প্রাথমিক মানদণ্ড তার প্রতিটিতেই পশ্চিমবঙ্গ এখন চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ। বাইরে বের হলে দেখা যাবে বেশিরভাগ জায়গায় রাস্তাঘাট বলতে আর কিছু নেই। যে কলকাতাকে সব সময় চাকচিক্যে মুড়ে রাখার চেষ্টা করা হয় সেখানেই রাস্তাভর্তি খানাখন্দ।
বাকি রাজ্যের কথা ছেড়ে দেওয়াই ভালো। সেখানে আদৌ রাস্তা বলে যে কিছু ছিল তা মনে করাই দুষ্কর হবে। বেশ কিছু ক্ষেত্রে কোথাও রাস্তা ঢেউ খেলানো পাহাড়ি পথে পরিণত হয়েছে! আবার কোথাও মনে হবে সেখানে বুঝি গুপ্তধনের সন্ধানে খোঁড়াখুঁড়ি চলেছে, তাই ইয়া বড় গর্ত তৈরি হয়েছে!
এই পরিস্থিতিতে নতুন করে রাস্তা তৈরি তো দূরের কথা, সরকারের কোষাগারের এমনই বেহাল দশা যে সামান্য জোড়া তাপ্পি পর্যন্ত দিতে পারছে না। আর সেতু তৈরীর ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রী নিজে প্রশাসনিক বৈঠকগুলিতে দলীয় বিধায়কদের বলে দিয়েছেন যে আর চাইলে চলবে না, সরকার এখন কিছুই তৈরি করতে পারবে না!
সব মিলিয়ে বলা যায় রাজ্যে পরিকাঠামো উন্নয়নের কাজ একপ্রকার থমকে গিয়েছে। এই বিষয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আজকাল বলতে শোনা যাচ্ছে- তিনি নাকি সব তৈরি করে দিয়েছেন, আর কিছু বাকি নেই। যদিও পরিকাঠামো নির্মাণ এক ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। তা কখনই থেমে থাকে না। আর তা যদি থেমে যায় তবে সংশ্লিষ্ট দেশ বা রাজ্যের অগ্রগতির চাকা স্তব্ধ হয়ে যাবে।
এদিকে উন্নয়নের কাজ বলতে মুখ্যমন্ত্রী আজকাল বড় বেশি করে জোর দেন গৃহহীনদের বাড়ি তৈরি করে দেওয়া অর্থাৎ বাংলা আবাস যোজনার উপর। ঠিক, গৃহহীনদের বাড়ি তৈরি করে দিলে মানুষের জীবন যাপনের মানোন্নয়ন ঘটে। কিন্তু এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এক অদ্ভুত চৌর্যবৃত্তির পরিচয় দিয়েছে। তারা কেন্দ্রের প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনাকে নিজেদের নামে চালাচ্ছে! এই বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সেভাবে কোনও অর্থ খরচ হয় না।
এরপর লক্ষ্মীর ভাণ্ডার। একুশের বিধানসভা নির্বাচনে জয়ের পর লক্ষ্মীর ভাণ্ডারর প্রকল্পকে তুরুপের তাস করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। মুখ্যমন্ত্রীর নিজেও বলছেন লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের খরচ জোগানোর জন্য অন্যান্য সরকারি খরচ কমাতে হবে। এটা ঠিক মহিলাদের ৫০০ টাকা (এসসি-এসটিদের ১,০০০ টাকা) করে দেওয়ার রাজনৈতিক ডিভিডেন্ড পাচ্ছে তৃণমূল। কিন্তু এতে মানুষের আদৌ বিন্দুমাত্র উপকার হচ্ছে?
প্রথম কথা, মাসে ৫০০ টাকা করে দিয়ে বর্তমান বাজার দরে কারোর কোনও মঙ্গল হয় না। হয়তো অতি প্রান্তিক কয়েক শতাংশ মানুষের কিছুটা সুরাহা হলেও হতে পারে। কিন্তু বাকি নিম্ন মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্তদের আলাদা করে কোনও লাভ হচ্ছে না। বরং যদি আলাদা করে প্রান্তিক মানুষদের এই টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হতো তাহলেও না হয় একটা মানে দাঁড়াতো।
সেক্ষেত্রে সরকারের খরচ যেমন কমত, তেমনই যাদের একেবারেই চলছে না তাদের কিছুটা হলেও উপকার হতো। কিন্তু তার বদলে সকলকে এই টাকা দেওয়াটা সরকারি অর্থের অপব্যবহার ছাড়া আর কিছুই নয়। তবুও মানুষ এই টাকা নেওয়ার জন্য হুটোপাটা করছে, কারণ ‘হকের অর্থ ছাড়ব না’, এটাই তাদের মনোভাব।
কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর দাবি যদি সঠিক হয় তাহলে ধরে নিতে হবে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্পের টাকা দিতে গিয়ে রাস্তাঘাট মেরামত সহ অন্যান্য পরিকাঠামো উন্নয়নের কাজ হচ্ছে না। এর ফলে মানুষের যাতায়াতের খরচ বা সাইকেল-বাইক মেরামতের খরচ যে বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে সেটার অঙ্ক সরকারের দেওয়া ৫০০ টাকার থেকে অনেকটাই বেশি। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের ফাঁদে পড়ে মানুষের মঙ্গলের থেকে অমঙ্গলটাই বেশি হচ্ছে!
তবে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার নিয়ে মানুষের এই হুড়োহুড়ির পিছনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় একেবারেই উড়িয়ে দেওয়ার নয়। ২০১১ সালে তৃণমূল বাংলার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সরকারি ক্ষেত্রে নিয়োগ একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। যেমন ধরা যাক পুলিশে নিয়োগ।
সঠিকভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়া চালালে অনেকেই একটা ঠিকঠাক কাজ পেতেন। কিন্তু তার মধ্যে একটা বড় অংশকে যৎসামান্য অর্থের বিনিময়ে সিভিক পুলিশ করে রাখা হয়েছে। আজকের দিনে ১০ হাজার টাকা ভাতায় সৎ পথে সংসার চালানো কতটা সম্ভব সেটা আপনারাই বিচার করুন!
তাও না হয় যারা সিভিক পুলিশ হচ্ছেন কিছু না করার বদলে অন্তত দুটো পয়সা রোজগার করার সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু রাজ্যের মেধাবী উচ্চশিক্ষিতরা, যারা গবেষণা করে বসে আছেন তাঁদের ভবিষ্যতের কী হবে? আশ্চর্যজনকভাবে তৃণমূল সরকার কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের অবসরের বয়সসীমা ৬০ বছর থেকে বাড়িয়ে প্রথমে ৬৫ করল, এখন আবার ৬৮ করার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
এর ফলে যারা অধ্যাপক হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন সেই সব তরুণ-তরুণীদের গোটা ভবিষ্যৎটাই গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে! এই সমস্ত মেধাবী পড়ুয়ারা পিএইচডি করার পরও বেকার হয়ে বসে থাকছেন। বলা ভালো সরকারের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে তাঁরা এক গভীর হতাশায় ধীরে ধীরে নিমজ্জিত হয়ে যাচ্ছেন।
বাম জমানায় দেখা গিয়েছিল রাজ্যের শিক্ষিতদের কর্মসংস্থানের একটা অন্যতম প্রধান জায়গা স্কুল শিক্ষকের চাকরি। প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক, অসংখ্য ছেলেমেয়ে স্কুল শিক্ষক হিসেবে নিজেদের ভবিষ্যত গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর এসএসসি বন্ধ হয়ে গেছে।
সরকারের একের পর এক ইচ্ছাকৃত ভুলের জন্য প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগও থমকে। এক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রী বারবার কোর্টে মামলা করাকে দায়ী করেন। কিন্তু বারবার যদি সরকার অন্যায় করে, তাহলে চাকরিপ্রার্থীদের বারবার আদালতের দ্বারস্থ হতেই হবে। এটা একটা স্বাভাবিক বিষয়। সেখানে সরকার বা সরকারি সংস্থাগুলো অনিয়ম না করে সঠিক পথে চললেই ল্যাঠা চুকে যায়!
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিবছর বিশাল আকারে শিল্প সম্মেলন করলেও রাজ্যে প্রকৃতপক্ষে বৃহৎ বিনিয়োগ কতটা কি এসেছে তা নিয়ে সংশয় আছে। অন্তত সাদা চোখে খুব একটা কিছু নজরে পড়ে না। ফলে এই কয়েক বছরে পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষিতদের জীবিকা নিয়ে এক বড় প্রশ্ন চিহ্ন দেখা দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের মতো প্রকল্প আসলে সান্তনা পুরস্কার। এতে অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া গেল আরকি!
ফিরে আসা যাক গোড়ার কথায়। যে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্পকে নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিশাল ঢাক পেটাচ্ছেন, যে প্রকল্পকে হাতিয়ার করে গোয়া দখলের স্বপ্ন দেখছে বাংলার শাসক দল, সেই লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্প মোটেও রাজ্যের মানুষের জীবন যাপনের মানোন্নয়ন ঘটাচ্ছে না। অর্থনীতির পরিভাষায় পশ্চিমবঙ্গে উন্নয়ন ঘটা তাই দূর কী বাত!
একটা বিষয় বুঝতে হবে, রাজ্যে যদি পরিকাঠামো উন্নয়ন থমকে যায় এবং মানুষের যদি জীবনযাপনের মানোন্নয়ন না ঘটে তবে শত লাফঝাঁপ দিলেও উন্নয়ন হবে না। বরং ‘উন্নয়ন’ শব্দটাই সেক্ষেত্রে কেবল মাত্র রাজনৈতিক আলোচনার বিষয় হয়েই থেকে যাবে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের উন্নয়ন নিয়ে এই ভ্রান্ত রাজনীতির কুফল আগামী বেশ কয়েকটি প্রজন্মকে যে ভোগ করতেই হবে তা হলফ করে বলা যায়। এই পরিস্থিতিতে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে আগামী দিনে নতুন প্রজন্মের একটা বড় অংশ শিক্ষা থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিতে পারে। সেক্ষেত্রে চরম পরিনতির দিকে এগিয়ে যাবে বঙ্গবাসী।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্দেশ্যে একটাই অনুরোধ, এই মুহূর্তে রাজ্যের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব পুরোটাই আপনার হাতে। তাই লক্ষ্মীর ভাণ্ডার দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লাভের চেষ্টা না করে প্রকৃত উন্নয়ন করুন। না হলে আজকের প্রজন্ম আপনাকে দুই হাত তুলে সমর্থন করলেও আগামী প্রজন্মের কাছে আপনি কিন্তু ‘খলনায়ক’ হয়েই থেকে যাবেন! মানুষকে বাঁচার মত বাঁচতে দিন, ধুঁকতে ধুঁকতে বাঁচাটা কোনও উদ্দেশ্য হতে পারে না।