উত্তরের কোনে অশনি সঙ্কেত
শুভজিৎ চক্রবর্তী
বাংলায় তোষণের রাজনীতি হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে দুই দিনের সফরে বলে গেলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। কিন্তু বঙ্গ রাজনীতিতে তৃণমূলের পর্যদস্তু হওয়ার কারণ শুধুমাত্র ‘তোষণ’ নয়। বরং বঙ্গ রাজনীতিতে আইপ্যাক সংস্থার উদয় এবং তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বই ডোবাবে শাসক দলকে। এই আলোচনায় এখন ভরে উঠেছে বাংলার অলিগলি।
২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে উত্তরবঙ্গ থেকে একটিও আসন পায়নি ঘাসফুল শিবির। বরং মোদি লেহেরে গা ভাসিয়ে ১৮ টি আসন বাংলা থেকে নিয়ে দিল্লিতে নিয়ে যায় গেরুয়া শিবির। এর জন্য দলের মিসম্যানেজমেন্ট এবং দলীয় নেতাদের রাজকীয়তাকে দোষারোপ করছে রাজনৈতিক মহল। যা বুথ স্তরের নেতাদের একেবারে না পসন্দ।
দলনেত্রীর মুখে বুথ স্তরের নেতাদের জন্য গুরুত্ব থাকলেও, জেলা স্তরের নেতাদের মধ্যে আড়াআড়ি মনোভাব থাকার কারণে লোকসভা নির্বাচনে ভরাডুবি হয় তৃণমূলের। তার ওপর সম্প্রতি প্রশান্ত কিশোরের আইপ্যাক সংস্থার উদয় যুব নেতৃত্বের সঙ্গে মাদার নেতৃত্বের দুরত্ব বাড়িয়েছে।
বর্ষীয়ান নেতৃত্বের ক্ষোভের কারণঃ
সম্প্রতি কোচবিহারের তৃণমূলের অবস্থানে তা স্পষ্ট হয়। ২১ জুলাইয়ের পর জেলা তৃণমূলের দায়িত্বভার বর্তায় যুব নেতা পার্থ প্রতিম রায়ের ওপর। তারপর থেকে বেজায় চটেছেন মমতা ঘনিষ্ঠ মায় তৃণমূলের বর্ষীয়ান নেতারা।
তৃণমূলের অন্দরের খবর, মুষ্টিমেয় বিধায়কদের নিয়ে সংগঠন চালাচ্ছেন পার্থ। তাই জেলা কমিটির বৈঠকের সময় পার্থ উপস্থিত থাকলেও অনুপস্থিত থাকেন বেশ কিছু বিধায়করা, আবার বিধায়কদের বৈঠকে অনুপস্থিত থাকেন স্বয়ং জেলা সভাপতি পার্থ প্রতিম রায়।
এমনিতেই ব্লক কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে সমঝোতা না হওয়ায় সমস্ত পদ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন কোচবিহার দক্ষিণের তৃণমূল বিধায়ক মিহির গোস্বামী।
দলের নয়, বরং প্রশান্ত কিশোরের আইপ্যাক সংস্থার ভূমিকা এবং মুখ্যমন্ত্রীর নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ক্ষোভ উগরে দেন তিনি। একই পথে হেঁটেছেন সিতাইয়ের বিধায়ক জগদীশ বর্মা বসুনীয়া।
তৃণমূল অন্দরের খবর, টিকিট পেলেই তবেই সক্রিয় ভূমিকায় ফিরে আসবেন সিতাই এবং শীতলকুচীর বিধায়ক জগদীশ বর্মা বসুনীয়া এবং হীতেন বর্মন।
দিনহাটার এলাকা দখলকে কেন্দ্র করে বিরোধী বিজেপি কিছুটা জায়গা পেলেও আপাতত তৃণমূলেই থাকছেন বিধায়ক উদয়ন গুহ এটা বলার অবকাশ নেই।
প্রত্যেকবারের মতো এবারেও জেলা সভাপতির সঙ্গে একটু জল মেপেই চলছেন অর্ঘ্য রায় প্রধান। সূত্রের খবর, মেখলিগঞ্জ এর পরিবর্তে ২১ এর নির্বাচনে তুফানগঞ্জ থেকে তৃণমূলের টিকিটে লড়াই করতে দেখা যেতে পারে তাঁকে।
তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে তুফানগঞ্জের তৃণমূল বিধায়ক ফজল করিম মিঞার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে। যদিও এবিষয়ে দলের তরফে কিছুই পাকাপাকিভাবে জানানো হয়নি।
এরই মাঝে নিজেকে কিছুটা গুটিয়ে রেখেছেন কোচবিহার তৃণমূলের প্রাক্তন জেলা সভাপতি ও উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ঘোষ। কেনই বা হঠাৎ করেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দীর্ঘ সময়ের সাথী এভাবে নিজেকে নিষ্ক্রিয় করছেন তার উত্তর এখনও মেলেনি।
তবে ঠাকুর মদনমোহনের জেলায় যে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয়েছে তা অচিরেই টের পাচ্ছেন বাংলার মানুষ।
বিমল গুরুঙের প্রত্যাবর্তনে নতুন সমীকরণঃ
অন্যদিকে বিমল গুরুংয়ের প্রত্যাবর্তনে পাহাড়ের রাজনীতিতে একটা বিরাট বদল আসতে চলেছে সেবিষয়ে বলার অবকাশ থাকে না। তবে সেই বদল ইতিবাচক নাকি নেতিবাচক তা বলা সম্ভব নয়।
কারণ এনডিএ ছেড়ে তৃণমূলের শিবিরে একসময় পাহাড়ের মোস্ট ওয়ান্টেড বিমল গুরুং ফিরে এলেও তাঁকে ‘ক্লোসড চ্যাপটার’ হিসাবে ধরেই নিয়েছেন বিনয় তামাং।
মহাপঞ্চমীর বিকেলে সল্টলেকে বিমল গুরুংয়ের রাজনৈতিক পালা বদলের খবর জানলেও, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে গুরুং নিয়ে কোনও আলোচনা হয়নি তা জানিয়ে দিয়েছিলেন তামাং।
ক্রমশ জিটিএর চেয়ারম্যান বিনয় তামাং এবং অনিত থাপাদেরকে নিয়ে পাহাড়ের মানুষের মধ্যে উৎসাহ বাড়তে শুরু করে। এরই মধ্যে ১৭ জন বিজেপি কাউন্সিলরদের মোর্চাতে ‘ঘর ওয়াপসি’ করিয়ে নজর কাড়েন বিমল গুরুং।
রাজনৈতিক মহলের মতে, অমিত শাহ পশ্চিমবঙ্গে থাকাকালীন এটা তৃণমূলের শক্তি প্রদর্শনের একটি পন্থা। যদিও ১৭ জন বিজেপি বিধায়কের ঘর ওয়াপসির অঙ্ক মানতে নারাজ বিনয় তামাং।
শুধুমাত্র পাহাড় নয়, বিমল গুরুংয়ের কামব্যাকে গোটা উত্তরবঙ্গের ভোটে বিরাট এফেক্ট পড়বে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। কিন্তু বিমল এবং বিনয়ের আড়াআড়ি মনোভাবের জেরে বিরোধীদের জমি পেতে সুবিধে নিশ্চিত বলে মনে করছেন অনেকেই।
যদিও পুর্বের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল এবং সম্প্রতি ১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে ফলাফলের ইঙ্গিত অনুযায়ী জলপাইগুড়ি এবং আলিপুরদুয়ারে ঘাসফুলের চাষ কমই হবে।
চা শ্রমিক ও আদিবাসী জনজাতি ইস্য়ুঃ
পাহাড় এবং তরাই এলাকাগুলিতে চা বাগানের শ্রমিকদের মধ্যে কেন্দ্রও এবং রাজ্যের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। তাও ১৯ এর নির্বাচনের মতো জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ারেও আদিবাসী এবং জনজাতি ইস্যুতে বাজিমাত করতে চাইছে বিজেপি।
শুধুমাত্র উত্তরবঙ্গ নয়, গোটা বাংলায় মতুয়া, রাজবংশী, আদিবাসী এবং জনজাতি ইস্যুকে সামনে রেখেই ঘুটি সজাবেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। সেখানে তৃণমূলের কাছে জায়গা করে নেওয়া বেশ চাপের হবে।
সমতলের সমীকরণঃ
কিন্তু পাহাড় থেকে নেমে আসলেই বদলাতে শুরু করবে সমতলের রাজনৈতিক সমীকরণ। রায়গঞ্জের যে টাফ ফাইটের পর দেবশ্রী চৌধুরী মন্ত্রীপদ পেলেন তার ওপর নজর রাখতে চাইছে গেরুয়া শিবির।
তাই তৃণমূলকে টেক্কা দিতে ইসলামপুরের ঘটনা এবং প্রয়াত বিজেপি বিধায়ক দেবেন্দ্রনাথ রায়ের ইস্যুকে সামনে তুলে ধরবে গেরুয়া শিবির। সেইসঙ্গে এই জেলা বাম-কংগ্রেসের পুরাতন ঘাঁটি হওয়ায় ভোটের অঙ্ক কষতে সুবিধেই হবে তাঁদের।
অন্যদিকে লোকসভা নির্বাচনে বালুরঘাট কেন্দ্রে অর্পিতা ঘোষকে প্রার্থী করায় তৃণমূল ছেড়ে বিজেপি শিবিরে যোগদান করেছিলেন বিপ্লব মিত্র।
কিন্তু বিধানসভার আগে বিপ্লব মিত্রের ‘ঘর ওয়াপসি’ অর্পিতা শিবির ভালোভাবে নেয়নি। তৃণমূলের অন্দরের খবর, রাজনৈতিক দুরত্ব বজায় রেখেই দল পরিচালনা হচ্ছে এই জেলাতে। ফলে বিরোধীদের জন্য এই জমি সুবিধের হবে।
২১ বিধানসভায় সবথেকে মালদহ নিয়ে সবথেকে বেশী ফাঁপরে পড়তে হবে তৃণমূল শিবিরকে। জেলায় একাধিক গোষ্ঠীর কারণে লোকসভায় একটাও আসন পায়নি তৃণমূল।
তার ওপর জেলার সভাপতির দায়িত্ব সদ্য কংগ্রেস থেকে আসা গণি খান পরিবারের সদস্য মৌসম বেনজির নুরকে দেওয়ায় মুখ ফিরিয়েছেন বর্ষীয়ান নেতারা।
এমনকি এই জেলার গোষ্ঠীকোন্দল নিয়ে জনসমক্ষে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন তৃণমূল সুপ্রিমো। কিন্তু তাতেও কিছু বদলায়নি।
বালি-পাথর পাচার চক্রে তৃণমূল যোগঃ
এছাড়াও উত্তরবঙ্গে গরু পাচার থেকে শুরু করে পাথর, বালি পাচারে বহু তৃণমূল নেতাদের নাম জড়ানোর কারণে দলের থেকে আস্থা হারিয়েছেন কর্মীরা। সূত্রের খবর, ১৯ এ উত্তরবঙ্গে বদলের পর তৃণমূলের ওপরে আস্থা রাখলেও এই মুহূর্তে জল মাপছেন মমতা ঘনিষ্ঠ নেতারা।
কারণ, তাঁদের অনেকের মতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখে রাজনীতি করার পর যদি এখন ২২-২৩ বছরের যুবকদের থেকে রাজনীতি শিখতে হয় তাহলে সেখানে সম্মানের কিছু থাকেনা।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, উত্তরবঙ্গে হাল ফেরতে ঘাসফুল শিবিরের অবিলম্বে উচিত গ্রাউন্ড লেভেলের নেতাদের ওপর দলের ভার দেওয়া। তবেই ২১ বিধানসভায় মোড় ঘোরাতে পারবে তৃণমূল।