বাংলার গর্ব মমতা’য় কখনই সিলমোহর দেবে না বাঙালি
||পার্থ প্রতিম বিশ্বাস||
||সম্পাদক, পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি||
২রার যাত্রাপালা
স্থান – নেতাজী ইনডোর স্টেডিয়াম।
প্রধান নায়ক এবং নায়িকা – মমতা ব্যানার্জী। পার্শ্বনায়ক – পি. কে.। দর্শক : শ্রোতা, সমর্থক এবং বাংলার অসংখ্য স্বঘোষিত ল্যাম্পপোষ্ট।
একদা জাতীয় কংগ্রেসের তৃণমূলস্তরের কর্মীদের সম্মানের ধুঁয়ো তুলে গড়া তৃণমূল দলটির প্রকৃত তৃণমুল স্তরের কর্মীদের অন্যতম মিমি চক্রবর্তী, নুসরাত জাহান, প্রসূন ব্যানার্জী, দেব অধিকারী, মুনমুন সেন, কেডি সিং, সন্ধ্যা রায়, যোগেন চৌধুরী, ইমরান হাসান, চৌধুরী মোহন জাটুয়া, মনিশ গুপ্ত সহ নানা রঙের খেটে খাওয়াদের প্রতি পেন্নাম জানিয়ে কিছু কথা।
সরকারী ক্ষমতায় যে দল থাকে, প্রশ্ন তাকেই করতে হয় এবং উত্তর তাদেরকেই দিতে হয়। ফলে তৃণমূল দল নিয়ে অহেতুক চিন্তা করা নয় বরং সরকারী দলের প্রতি প্রশ্ন করার অধিকার বলেই এই লেখা বা অবতারণা।
প্রসঙ্গ # বিসি_টিএমসি
গত কয়েকদিন ধরেই এই ‘বিসি-টিমসি’ কথাটা সামাজিক মাধ্যমে ঘোরাফেরা করছিল। অনেক কষ্টে কথাটার যা মানে জানতে পারলাম তা হলো ‘বারকোড টিএমসি’।
দীর্ঘবছর ধরে এ বাংলার রাজনীতির সাথে জড়িয়ে থাকা ও খবরাখবর রাখার সুবাদে একথা বলতেই পারি যে, আজ পর্যন্ত কোনওদিন কোথাও এই ‘বারকোড’ রাজনীতি নামক বিষয়টির কথা শুনিনি। তবে যা শুনলাম তা হলো, ২ মার্চ, ২০২০, তৃণমূলের ইনডোর স্টেডিয়ামের অনুষ্ঠানে তারাই ঢুকতে পেরেছেন, যাদেরকে পিকে (দিদির ভাড়া করা মাস্টের) তার বারকোড রাজনীতিতে স্থান দিয়েছেন।
আরও পড়ুনঃ আওয়াজ একটাই ‘লড়কে লেঙ্গে হিন্দুস্তান’
অনুষ্ঠানে প্রবেশের আগে রীতিমতো সেই বারকোড স্ক্যান করে তবেই তৃণমূলীদের ঢুকতে দেওয়া হয়েছে। তৃণমূল সূত্রে এটাও শোনা গেল যে, ইনডোরের সভায় স্থান পেয়েছিলেন মাত্র ২৫ হাজার লোক। ক্ষমতাশীন দলের বহু ক্ষমতাশালী ও বাহুবলীরা বারকোড না পাওয়ায় এই সভায় প্রবেশাধিকার পাননি।
যদিও বিগত বছরগুলিতে তারা দিদির নামে জয়ধ্বনি করে এসেছেন এবং দিদির শর্তে সব পঞ্চায়েত দখল থেকে ৭৫ : ২৫ শর্ত মেনে তোলাবাজি থেকে সিন্ডিকেট, সবেতেই অংশগ্রহণ করে এসেছেন। আজ তাদের সেই গোপালের মতো অবস্থা। মাসির কথায় নিয়মিত চুরি করে মাসির সংসার সাজানো গোপালকে যখন মাসির সামনে থেকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে।
তখন দেখার বিষয় এই যে, ‘কোমরে দড়ি বাঁধিয়া লইয়া যাইবার সময়ে আজকের গোপালরা মাসি থুড়ি পিসিকে পিসি একবার এদিকে আইস, কানে কানে কিছু কথা আছে বলিয়া পিসির কান কামড়াইয়া কাটিয়া লয় কিনা!’
প্রসঙ্গ # কুনাল_ঘোষ
মাত্র দু’সপ্তাহ আগেই প্রাক্তন তৃণমূলী সাংসদ তাপস পালের মৃত্যুর কারণ হিসাবে মমতা ব্যানার্জী যখন কেন্দ্রীয় সরকার তথা সিবিআইকে কাঠগড়ায় তুলছিলেন, তখন তৃণমূলের আর এক প্রাক্তন সাংসদ ও সাংবাদিক কুনাল ঘোষ পাল্টা প্রশ্ন তুলে বলেছিলেন যে, তাপস পালের মৃত্যু নিয়ে দিদির বক্তব্য সঠিক হলে, তার মায়ের মৃত্যুর জন্য বর্তমান রাজ্য সরকার দায়ী।
কুনাল ঘোষের সাথে আমার ব্যাক্তিগত সম্পর্ক এবং চীটফান্ড কান্ডে কুনাল ঘোষের বিরুদ্ধে হওয়া মামলাগুলো সম্পর্কে যতটুকু বুঝি বা আন্দাজ করতে পারি, তাতে একথা অনায়াসেই বলা যায় যে, কুনাল ঘোষকে যদি চীটফান্ড মামলায় আড়াই বছর জেল খাটতে ও আজও ৪০০-রও বেশী মামলায় বিচারের অপেক্ষায় থাকতে হয়, তাহলে এই তৃণমূলের বহু মাতব্বর এমনকি হয়তো ওদের মালকিনকেও একই অপরাধে আরও অনেক বেশী সময় ধরে জেলের ঘানি পেষার কাজ করতে হতো।
আরও পড়ুনঃ দেশ গড়তে ভোট দিন শিক্ষিত সজ্জন প্রার্থীকে
কিন্তু দু’চার জন ছাড়া আর কারও ক্ষেত্রেই সে অবস্থা হয়নি। কুনাল ঘোষের জেলজীবন কালে তৃণমূলীরা সরকারি ও বেসরকারি ভাবে তাকে কি পরিমাণ হেনস্তা করেছিল তা সকলেই জানেন এবং আইনের ভাষায় তা ম্যাটার অফ রেকর্ড। যদিও কুনাল ঘোষ জেল থেকে বেরিয়েও ‘আমি তৃণমূলের কর্মী’ বলে বারবার দাবি করেছেন।
তবুও তৃণমূল মালকিন কিন্তু তাকে মোটেও জায়গা দেননি। অবাক কান্ড ঘটিয়ে একদা ব্রাত্য ও অত্যাচারিত কুনাল ঘোষও নেতাজী ইনডোরের সভায় স্থান অর্থাৎ ‘বারকোড’ পেলেও তৃণমূলের বহু মাতব্বরের কপালে সে বারকোড জোটেনি।
এটা দিদি না পিকে, কার কারসাজি এসব নিয়ে তদন্ত করা যেতেই পারে, তবে সভায় যখন দিদির গলায় স্পষ্ট শোনা গেল, যারা ভালো কাজ করবে তারাই দলের টিকিট পাবে, তখন বারকোড না পাওয়া নেতা-মাতব্বরদের কপালে অচিরেই যে কাঁচকলা ঝুলবে (?) তা সহজেই অনুমেয়।
প্রসঙ্গ # নম্র_ব্যাবহার
দিদি এ রাজ্যের শতাধিক পুরসভা ও আগামী বছরে হতে চলা বিধানসভা নির্বাচন উপলক্ষে দলের সর্বস্তরের কর্মীদের নম্র ও বিনয়ী হওয়ার উপদেশ দিয়েছেন। বলেছেন, মানুষের কাছে যেতে, বলেছেন গরীবদের কোলে তুলে নিতে এবং এরকম আরও অনেক মিষ্টি মিষ্টি কথা, যার প্রকৃত অর্থ কি তা বুঝতে পারাটা কিন্তু বেশ জটিলকাজ।
প্রশ্ন হলো, তবে কি ক্ষমতায় আসর পর থেকে তৃণমূলীরা যে রাজ্যবাসীর সাথে আদৌ নম্রভদ্র ব্যাবহার করেননি, সেই অভিযোগে কোনো ভুল নেই?
তবে কি আগামী ২০২১ সালে ক্ষমতা হারানোর ভয়ে দিদি আপাতত তার চ্যালাদের নম্রভদ্র সেজে অর্থাৎ ভদ্রতার মুখোশ পরে ভোট কুড়ানোর পরামর্শ দিলেন? সামনেই পুরভোট, বছর ঘুরলেই বিধানসভার ভোট।
তাই, বাছারা আপাতত তোমরা নম্রভদ্র হয়ে আমার জন্য ভোট কুড়াও। ভোটের শেষে আমি ক্ষমতায় বসার পরেই না হয় আবারও তোমরা পুরানো রূপ ধরে সিন্ডিকেট তোলাবাজি স্বজনপোষণের মহিমায় ফিরে যেও!
এতদিন তার দলের কর্মীরা যদি সত্যিই নম্রভদ্র ব্যবহার করত তাহলে তাকে ‘দিদিকে বলো’ করতে হলো কেন? কেন মমতা ব্যানার্জী প্রকাশ্য সভায় বলেন যে, ‘তৃণমূল দলের স্থানীয় নেতাদের বিশ্বাস করবেন না!’ কেন তাকে বলতে হয়, ‘২৯৪ টা বিধানসভা কেন্দ্রেই আমাকে দেখে ভোট দিন’। তাহলে এত ল্যাম্পপোষ্ট বা আপদবিপদদের পুষে রেখে বাংলার ক্রমাগত ক্ষতি করার দরকার কি ?
দিদির ভাষাতেই ‘একা সব খেও না, যা নিচ্ছো তা ৭৫ ভাগ দলকে দিয়ে বাকী ২৫ ভাগ নিজেরা খাও’ ইত্যাদির অর্থ কি? এসবের প্রকৃত অর্থ কি এই নয় যে, তিনি নিজেই ক্ষমতায় থাকতে এইসব লেঠেলবাহিনীদের ব্যাবহার করেন, আর ক্ষুব্ধ প্রজা তথা জনতার জ্বলন্ত ক্ষোভ প্রশমিত করতে মাঝেমাঝে সেই লেঠেলদের প্রকাশ্য সভায় একটু বকাবকি করার নাটক করে পরিস্থিতিতে একটু বদল করার চেষ্ট করেন।
এর মানে তো সবটাই আসলে তিনি এবং তাঁর ইন্দ্রজাল? তাহলে তাকেই আসল ডাকুরানী ভাবলে কি খুব ভুল ভাবা হবে?
পুনশ্চঃ – দিদির প্রিয় ভাই বীরভূমের অক্সিজেন অনুব্রতর সাম্প্রতিকতম আগাছা ছাঁটার নিদান কি তৃণমূলী নম্রতার অন্যতম নিদর্শন?
প্রসঙ্গ # পিকে
রাজনৈতিক দল ও তার সংগঠন পরিচালনার ক্ষেত্রে ভারতবর্ষের অন্যত্র কি হচ্ছে বা কে কি করছে সেই প্রসঙ্গের সাথে এ বাংলার রাজনীতি বা রাজনৈতিক সংগঠনের কোনও মিল নেই। বাংলা বরাবরই অন্য মাত্রায় চলে। তাই জানতে চাই, বাংলার চিরাচরিত রাজনীতির মঞ্চ ওই পিকে নামক ব্যাক্তিটি কে?
তাহলে জাতীয় কংগ্রেসের তৃণমুলস্তরের কর্মীদের সম্মানের ধুঁয়ো তুলে যে দলের জন্ম, যে দলের মালকিন একদা নিজেকে ‘সততার প্রতীক’ বলে প্রচার করতে পছন্দ করতেন, সমাজে তথা রাজ্যে সেই মমতা ব্যানার্জীর প্রভাব কি কিছু কম পড়িয়াছে? তাই কি ল্যাংড়ার ক্র্যাচের মতো পিকের কাঁধে চেপে নতুন করে গল্প লেখার চেষ্টা?
আরও পড়ুনঃ আস্থা হারিয়েছে মমতার দল, বিকল্প হতে পারে বাম-কংগ্রেসের সার্বিক জোট
ক্ষমতায় না কুলালেও বা গিলতে না পারলেও কি চিবাতেই হবে? বলতে পারেন, চাকরি নেই, শিল্প নেই, কৃষি পণ্যের দাম নেই, নারীদের সম্মান নেই এবং এরকম আরও হাজারও ‘নেই’ এর এ বাংলার আরও কতটা ক্ষতি হলে তবেই সত্যি সত্যি শ্যাওড়া গাছের ডালটা ভাঙবে?
প্রসঙ্গ # বাংলারগর্বমমতা
বাংলা বা বঙ্গপ্রদেশ-এর কথা বলতে হলে পূর্ব এবং পশ্চিমবঙ্গ মিলিয়ে পুরো জায়গাটা নিয়েই ভাবা, বলা, বোঝা এবং বোঝানো উচিত। এক্ষেত্রে আমার একটা বক্তব্য আছে। তা হলো, এই বিশ্বে যতজন মানুষ হিসাবে জন্ম নিয়ে, সময় ও বাকী মানুষদের বিচারে ঈশ্বরে রুপান্তরিত হয়েছেন, তাদের মোট সংখ্যা যদি ১০০ ধরা হয় তাহলে ওই ১০০ র প্রায় ৯০ শতাংশই এই ভারতে জন্মেছেন এবং ভারতে জন্মানো সেই প্রায় ৯০ শতাংশের ৮০ শতাংশই এই বাংলার ভূমিতে জন্মেছেন।
কে নেই সেই তালিকায়? তাই বরাবরই বাঙালীর কিন্তু গর্বের কোনও অন্ত নেই। তবে বাঙালীকে চিরকাল গর্বিত করা সেই লম্বা তালিকায় মমতা ব্যানার্জীর নাম ঢোকাতে হলে, সে কাজ কখনই সুস্থ মস্তিষ্কে, সরল অন্তঃকরণে অন্যের দ্বারা প্ররোচিত না হইয়া করা সম্ভব নহে।
তবে তৃণমূলের গর্ব যে মমতা, একথা ২০০ ভাগ সঠিক। শুধু গর্ব কেন তৃণমূলের ১০০০ ভাগ গর্তও মমতা। মমতা আছে তাই তৃণমুল আছে। মমতা নেই তো তৃণমুল নেই।
ম্যাজিসিয়ান পিসি সরকার এর ক্ষেত্রে আমরা পিসি সরকার সিনিয়র, জুনিয়র, ইয়ং এবং মানেকা (নিউ 😀) কে দেখতে পেলেও, মমতা পিসির সরকার ও তৃণমূলের সংসারে পিসি না থাকলে একরাতেই যে তৃণমূলের পৃথিবী চির অন্ধকারে ডুবে যাবে একথা স্বয়ং মমতাও জানেন এবং মানেন।
ফলে ‘তৃণমূলের ক্ষমতার উৎস ও তার রক্ষণাবেক্ষণের একমাত্র সুরভিত এ্যান্টিসেপটিক ক্রিম মমতা’। মমতাই তৃণমূলের এক এবং একমাত্র গর্বের বিষয়, একথা গতকাল জন্ম নেওয়া শিশুটাও জানে এবং মানে।
আর তৃণমূল দলের কর্মীরাও যখন গর্ব করেই বলেন যে, ‘আমাদের দলে একটাই পোষ্ট বাকী সব ল্যাম্পপোষ্ট’ তখন তৃনমূলের একমাত্র গর্ব যে মমতা ব্যানার্জী, একথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।
তবে, ‘বাংলার গর্ব মমতা’ একথা কোনও মতেই বলতে বা মানতে পারছি না। আদৌ এই দাবি সত্যি বলে মানা সম্ভব কিনা, সে কথা বলার জন্যও অন্তত আরও কুড়িটা বছর সময় লাগবে। তাই তৃণমূলীরা যতই মমতাকে সেন্ট উপাধি দিন না কেন বাঙালীরা কখনই সেই মতে সিলমোহর লাগাচ্ছে না।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ এই প্রতিবেদন লেখকের একান্ত ব্যক্তিগত। #TheQuiry কোনোভাবেই দায়ী না।