নবীন-প্রবীণের মেলবন্ধনে রোডম্যাপ মমতার

দ্য কোয়ারি ওয়েবডেস্কঃ উনিশের লোকসভা নির্বাচনকে পেছনে ফেলে একুশের বিধানসভা নির্বাচনের লক্ষ্যে ঘর গোছানোর প্রক্রিয়া শুরু করল রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস। আর সেই লক্ষ্যে প্রত্যাশামতোই সাংগঠনিক স্তরে বড়সড় রদবদল ঘটাল শাসক শিবিরে।

বৃহস্পতিবার তৃণমূল স্তর থেকে কার্যত ঢেলে সাজানো হচ্ছে সংগঠনকে। জেলায়-জেলায় যেমন নতুন মুখ তুলে আনল তৃণমূল।

একইসঙ্গে দলের নবগঠিত রাজ্য কমিটিতেও স্বচ্ছভাবমূর্তির নেতাদেরই গুরুত্ব দেওয়া হল। নবীন প্রবীনের মেলবন্ধনে এদিন নিজেহাতেই তৈরি করলেন ‘টিম মমতা’।

একুশে জুলাইয়ের মঞ্চ থেকেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এদিন বড়সড় রদবদলের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। রাজ্যে বিজেপির বাড়বাড়ন্ত, লোকসভার ফলের পর তৃণমূলের সংগঠনে রদবদল প্রত্যাশিতই ছিল, কিন্তু তা যে এমন ব্যাপক হারে হবে, তা আন্দাজ করতে পারেননি অনেকেই। বাস্তবে হল তেমনই।

এদিন জেলাগুলি থেকে পর্যবেক্ষকের পদ অবলুপ্ত করা হল। তাঁর বদলে ওই জেলা চেয়ারম্যান নামে নতুন পদ তৈরি করা হল।

সম্প্রতি তৃণমূলের অন্দরে দুর্নীতি নিয়ে ঝড় তুলেছিলেন রাজীব। তাঁকে রাজ্য কমিটিতে আনা তৃণমূল নেত্রীর মাস্টারস্ট্রোক বলে মনে করছেন অনেকেই। বিধানসভা ভোটের কথা মাথায় রেখেই তৈরি হয়েছে ২১ জনের একটি কমিটি। সেই কমিটিতেই এলেন এই নতুনরা।

অন্যদিকে, ছত্রধর মাহাতোর রাজ্য কমিটিতে অর্ন্তভুক্তিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহলের একটা বড় অংশ। জঙ্গলমহলে বিজেপির অগ্রগমন রুখতে ছত্রধরকে রাজ্য কমিটিতে রাখাকেও পাকাপোক্ত পরিকল্পনার অঙ্গ হিসাবে মনে করছেন অনেকেই।

উনিশের লোকসভায় জঙ্গলমহল এবং উত্তরবঙ্গে গেরুয়া শিবিরের কাছে তৃণমূলের শোচনীয় হার থেকে বেশ শিক্ষা নিয়েছে তৃণমূল। অথচ জঙ্গলমহল তৃণমূলের রীতিমতো শক্ত ঘাঁটি ছিল। মাওবাদী সমস্যা দমন করে সেখানে শান্তি ফেরানোর প্রতিদান স্বরূপই সেখানকার জনসমর্থন আদায় করতে সক্ষম হয়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী।

তবে বছর কয়েক আগে থেকে গেরুয়া শিবিরের আচমকা এসব জায়গায় ঘাঁটি গেড়ে বসে উনিশের ভোটে জঙ্গলমহলের মূল তিন জেলা – ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া থেকে তৃণমূলের সাফ হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনার সাক্ষী হতে হয়েছে। সেই জঙ্গলমহলে হৃত সমর্থন পুনরুদ্ধার করতে ফের সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন মমতা। তাই সেই জায়গার দায়িত্ব দিয়ে তিনি সরাসরি রাজ্য কমিটিতে নিয়ে এলেন ছত্রধর মাহাতোকে।

বাম আমলে পুলিশি অত্যাচারের বিরুদ্ধে জঙ্গলমহলে গড়ে ওঠা জনসাধারণ কমিটিতে ছত্রধর মাহাতোর ভূমিকা কী ছিল, তা বেশ ভাল জানতেন তৎকালীন বিরোধী দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখনও তাই লালগড়-সহ জঙ্গলমহলের একাংশে ছত্রধরের মতো ব্যক্তিত্বের কী প্রভাব, তা তিনি সম্যক উপলব্ধি করেছেন।

গত বছর জেলমুক্তির পর ছত্রধর নায়কের মতো লালগড়ে নিজের গ্রামে ঢুকেছিলেন। তাঁকে নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে এখনও কত আবেগ, তা বুঝেছিলেন সকলে। তখনই জল্পনা উসকে উঠছিল, তবে কি এবার সরাসরি মূলস্রোতের রাজনীতিতে ফিরছেন ছত্রধর? তখন এ প্রশ্নের উত্তর মেলেনি, মিলল এদিন।

ছত্রধরকে সামনে রেখেই ফের ওই অংশের রাজনৈতিক ক্ষমতা ফিরে পেতে চাইছেন মমতা। তাই সরাসরি তাঁকে রাজ্য কমিটির সদস্য করার ঘোষণা করলেন।

জঙ্গলমহলের ছাড়াও আরও তিন জেলা নিয়েও বড়সড় সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এদিন পুরুলিয়ার জেলা সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হল মন্ত্রী শান্তিরাম মাহাতোকে। বদলে নতুন সভাপতি হলেন গুরুপদ টুডু, যিনি আবার সম্পর্কে আরেক মন্ত্রী সন্ধ্যারানি টুডুর স্বামী।

শান্তিরাম মাহাত দীর্ঘদিন ধরে জেলা সভাপতির দায়িত্ব সামলালেও তাঁর বিরুদ্ধে কিছুটা নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ উঠছিল বেশ অনেকদিন ধরে। মমতা তাঁকে একাধিকবার সাবধানও করেন। এবার তাঁকে দায়িত্ব থেকেই সরিয়ে দেওয়া হল।

ঝাড়গ্রামে নেত্রীর নিজের অত্যন্ত পছন্দের পাত্রী বীরবাহা সোরেনকে সরিয়ে দেওয়া হল একুশের দিকে চোখ রেখে। তাঁর জায়গায় জেলা সভাপতি হলেন দুলাল মুর্মু। বাঁকুড়ায় তৃণমূলের নতুন জেলা সভাপতি হলেন শ্যামল সাঁতরা।

অন্যদিকে, উত্তরবঙ্গেও লোকসভা ভোটের খারাপ ফলাফল থেকে শিক্ষা নিয়ে সেখানেও রদবদল ঘটালেন তৃণমূল নেত্রী। দক্ষিণ দিনাজপুরের জেলা সভানেত্রীর পদ থেকে সরানো হল অর্পিতা ঘোষকে। নতুন জেলা সভাপতি গৌতম দাস। এই জেলাতেও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের আঁচ ভালই পড়েছিল। তা একেবারে বন্ধ করে দিতেই এই পরিবর্তন আনা হল বলে মনে করা হচ্ছে।

এছাড়া কোচবিহারে দলের একচ্ছত্র রাজ ছিল মন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ঘোষের। তিনি ছিলেন সভাপতিও। কিন্তু লোকসভায় সেখানে কার্যত ধুয়েমুছে গিয়েছে তৃণমূল। তাই রবীন্দ্রনাথ ঘোষকে সরিয়ে সেখানে সভাপতি করা হয়েছে তরুণ পার্থপ্রতিম রায়কে।

নদিয়ার সাংসদ হিসেবে যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছেন মহুয়া মৈত্র। তরুণ রক্তের এই নেত্রীর কাজ করার ক্ষমতা দলেও প্রশংসিত। এবার গোটা নদিয়া জেলার সভাপতি করা হল মহুয়াকেই।

এদিন দলের যুব সংগঠনেও বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বদবদল করা হয়েছে। দুই কলকাতার যুব সভাপতি বদল করা হয়েছে। দক্ষিণ কলকাতার যুব সভাপতির দায়িত্বে স্বরূপ বিশ্বাসের বদলে দেওয়া হয়েছে ১১০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর বাপ্পাদিত্য দাশগুপ্তকে।

অন্যদিকে উত্তর কলকতায় জীবন সাহার জায়গায় যুব সভাপতি হলেন, ১৩ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর অনিন্দ রাউত। এদিন আরও বড় চমক রয়েছে এই তালিকায়, সিপিএমের প্রাক্তন সাংসদ ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়কে অলিপুরদুয়ারের দায়িত্ব দেওয়ার পাশাপাশি রাজ্য সেক্রেটারীর দায়িত্ব দেওয়া হল তাঁকে।

সম্পর্কিত পোস্ট