Singur : বাংলার ভোটারদের ভুলেই সিঙ্গুর জট!
সিঙ্গুর সমস্যা
The Quiry : Singur রাজনৈতিক নেতারা কথায় কথায় বলে বসেন, ‘জনতা জনার্দন’। ভুল কিছু বলেন না। কারণ জনতার ভোটেই নির্বাচিত হয়ে তাঁরা কেউ ক্ষমতায় আসেন, আবার কেউ ক্ষমতার বৃত্ত থেকে পাঁচ বছরের জন্য সম্পূর্ণ ছিটকে যান। আবার ঘরোয়া আলোচনায় বহু হোমরা চোমরা রাজনৈতিক নেতাদের আমজনতার সিদ্ধান্ত এবং অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলতে দেখা যায়। অনেকেই আলাপচারিতায় সাধারণ মানুষের বিচার বুদ্ধি নিয়েও প্রশ্ন তোলেন।
তবে আমজনতার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং বিচার বুদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন তোলাটা যে শুধুই চার দেওয়ালের অন্তরালে হয় এমনটা কিন্তু নয়। প্রকাশ্যেও একই ধরনের কথা বলতে শোনা যায় রাজনৈতিক নেতাদের। তবে সেটা কিছুটা ঘুরিয়ে, মার্জিত ভাষায় উপস্থাপন করে থাকেন তাঁরা। এই যেমন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে হামেশাই প্রকাশ্যে বলতে শুনবেন, আমরা মানুষকে বোঝাতে পারিনি, মানুষ আমাদের ভুল বুঝেছে, মানুষের মনোভাব আমরা ধরতে পারিনি, মানুষকে আরও ভাল করে বিষয়টা বোঝাতে হবে ইত্যাদির মত বহু কথা। যেগুলো আপাতভাবে শুনতে বেশ ভালো লাগলেও খুঁটিয়ে খেয়াল করলে বুঝতে পারবেন নিজেদের থেকে আমজনতাকে কোথাও একটা কম বুদ্ধি ও বিবেচনা সম্পন্ন বলে ধরে থাকে রাজনৈতিক দলগুলো। কিন্তু সেটা সরাসরি বলতে পারে না ভোট হারানোর ভয়ে। তাই এমন ঘুর পথে মানুষকে বোঝানোর কথা দলীয় কর্মী সমর্থকদের পরামর্শ দিয়ে থাকে তারা।
কিন্তু রাজনৈতিক নেতাদের আমজনতা সম্পর্কে এই অবস্থান বা ভাবনা যে সব সময় ভুল এমনটাও নয়। অন্তত বাংলার রাজনীতিতে সিঙ্গুর জট সেই বিষয়টাই প্রমাণ করে দিচ্ছে। সোজাসুজি বলতে হলে, বাংলার মানুষের বিবেচনাহীন সিদ্ধান্ত এবং অস্থির মনোভাবের ফলাফল সিঙ্গুরের জমি নিয়ে এই জটিলতা।
সিঙ্গুর সমস্যা নিয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলার বেকাররা।
আরও খবর-Kolkata Port : কলকাতা বন্দরে টেকনিশিয়ান পদে নিয়োগ
সরাসরি আমজনতা তথা সাধারন ভোটারদের নিশানা করায় অনেকের মধ্যে বিস্ময় তৈরি হতে পারে। কিন্তু একটা বিষয়ে পরিষ্কার মানতেই হবে, আমজনতা তার নিজস্ব অবস্থান নির্ধারণে আত্মবিশ্বাসের পরিচয় দিয়ে উঠতে পারেনি। সেই সঙ্গে সিঙ্গুর সমস্যা নিয়ে ভোটারদের ঘোলাটে অবস্থানের শিকার হয়েছে সিপিএম এবং তৃণমূল দুই প্রধান রাজনৈতিক দলই। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলার বেকাররা। সেই অর্থে বলতে গেলে পশ্চিমবঙ্গের ভোটাররা অবিবেচকের মত একের পর এক সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজেরাই নিজেদের পায়ে কুড়ুল মেরেছেন!
২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে সময় বামফ্রন্টের পক্ষ থেকে স্লোগান তোলা হয়েছিল- কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ। এই শ্লোগানের অর্থ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বামেরা পরিষ্কার জানিয়েছিল, তারা যদি সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার গঠন করতে পারেন তবে ব্যাপক শিল্পায়নের দিকে নজর দেবে। যুক্তি হিসেবে বলেছিল, এবার ভারী শিল্প না এলে রাজ্যের শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের কাজের সুযোগ করে দেওয়া যাবে না।
নির্বাচনের ফলাফল বের হলে দেখা যায় রেকর্ড সংখ্যক আসন জিতে ক্ষমতায় ফিরেছে বামফ্রন্ট। তৈরি হয় সপ্তম বাম সরকার। এই ভোটের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে রাজ্যের মানুষ মোটামুটি ঢেলেই ভোট দিয়েছিল বামেদের। এর থেকে সহজ সমীকরণে আসা যেতেই পারে যে বামেদের শিল্পায়নের পদক্ষেপের প্রতি রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন ছিল। খুব স্বাভাবিকভাবেই এই বিশাল জনসমর্থনের পর বাম সরকার শিল্পায়নের দিকে এগিয়েছিল এবং তার প্রথম উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হিসেবে সিঙ্গুরে টাটাদের গাড়ি তৈরির কারখানার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
কিন্তু বিপত্তিটা ঘটল এরপরই। বিরোধীদল হিসেবে তৃণমূল গাড়ি কারখানার বিরোধিতা করেছিল। সেটা আলাদা প্রসঙ্গ। কিন্তু দেখা গেল কদিন আগে ভোট দিয়ে সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার গঠন করা বাংলার আমজনতাই শিল্পায়ন প্রসঙ্গে হঠাৎ সরকারের বিরোধিতা করতে শুরু করে। অথচ তারাই কিছু মাস আগে এই শিল্পায়ন প্রশ্নেই ভোট দিয়ে গঠন করেছিল সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার। এক্ষেত্রে দুটো বিষয় হতে পারে। এক, খুব একটা বিবেচনা করে মানুষ সেই সময় ভোট দেয়নি। আর না হলে তাঁরা ভেবেছিলেন এক আর ভোট বাক্সে গিয়ে করে এসেছিলেন আরেক কাজ।
আমজনতার সিদ্ধান্তহীনতা এখানেই শেষ নয়। তাঁদের এই অবিবেচক কাজকর্মের শিকার যে শুধু বামেরা হয়েছে তা নয়। এর কুফল ভোগ করতে হচ্ছে তৃণমূলকেও। ২০১১ সালে বামেদের বিপুলভাবে পরাস্ত করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রাখে পশ্চিমবঙ্গবাসী। ওই বিধানসভা নির্বাচনের আগে তৃণমূল তাদের ইশতেহার থেকে শুরু করে বক্তব্যে পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছিল তারা শিল্পায়নের নামে কখনই জমি অধিগ্রহণের পক্ষে নয়। অর্থাৎ তারা সরকার গঠন করলে শিল্পপতিদের রাজ্যে স্বাগত জানাবে, কিন্তু জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে বিশেষ একটা সাহায্য করতে পারবে না। সেই কাজ শিল্পপতিদের নিজে থেকে করতে হবে। এর অর্থ কী দাঁড়ায় সেটা সকলেই মোটামুটি বোঝেন। এর একটাই সহজ অর্থ রাজ্য সেক্ষেত্রে ভারী শিল্প গড়ে ওঠা প্রায় অসম্ভব।
শিল্পায়ন নিয়ে তৃণমূলের এই অবস্থানের পরও ২০১১ সালের মানুষ তাদের বিপুলভাবে ভোট দিয়েছিল। যার একটা সহজ মানে দাঁড়ায়- বাংলার জনতাও সেই সময় শিল্পায়ন নিয়ে অতটা আগ্রহী ছিল না। বরং শিল্পায়নের থেকেও নিজের জমি নিজের কাছে ধরে রাখাটা তাঁদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে গত এক দশকে সম্পূর্ণ উল্টো ছবি দেখা যাচ্ছে। উল্লেখ্য এর মধ্যে আরও দুটো বিধানসভা ভোটে জিতেছে তৃণমূল। কিন্তু শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ নিয়ে তাঁদের রাজনৈতিক অবস্থানের কোনও পরিবর্তন ঘটেনি। তার ফলস্বরূপ বাংলায় তেমন কোনও শিল্পও আসেনি গত ১২ বছরে।
পরপর তিনটি বিধানসভা নির্বাচনে বাংলার মানুষ বিপুলভাবে তৃণমূল কংগ্রেসকে সমর্থন করল। যার অর্থ শিল্পায়নে তাদের নীতি মেনে নিয়েছে। অথচ কার্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে এই বাংলারই সাধারণ মানুষ রাজ্যে শিল্প না হওয়ার জন্য সরকারের তীব্র সমালোচনা করছে। কেন রাজ্যে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হচ্ছে না, বাংলার ছেলেমেয়েদেরকে জীবিকার সন্ধানে ভিন রাজ্যে পাড়ি দিতে হচ্ছে এই নিয়ে বাংলার সরকার এবং শাসক দলকে নানান কটাক্ষে বিদ্ধ করছে খোদ আমজনতা।
এক্ষেত্রেও আমজনতার নীতিগত অবস্থান এবং কাজের মধ্যে বিস্তর ফারাক। পরপর তিনটি বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলকে ভোট দিয়ে তাঁরা যখন ক্ষমতায় এনেছে তখন ধরে নিতে হবে যে রাজ্যে ভারী শিল্পায়ন চাইছেন না বেশিরভাগ রাজ্যবাসী। বরং তাঁরা চান ছোটখাটো শিল্পের মাধ্যমেই জীবিকার ব্যবস্থা হোক, যাতে কাউকে নিজস্ব জমি হারাতে না হয়। এই অবস্থানের ভিত্তিতে ভোট দিয়েও সরকারের সমালোচনা বুঝিয়ে দেয় ২০০৬ সালের নির্বাচনে বাংলার জনতা নিজেদের যে বিভ্রান্তির পরিচয় দিয়েছিল তা আজও অব্যাহত আছে।
ভোটার তথা আমজনতার এই তীব্র সমালোচনা দেখে অনেকেই নানান প্রশ্ন তুলতে পারেন। বহুজন বলতে পারেন ভোট কখনও একটি সহজ সরল সমীকরণের উপর ভিত্তি করে হয় না। তার পিছনে নানান কারণ থাকে। কেউ হয়তো তাঁর এলাকায় সঠিকভাবে জল পান না। আবার কারোর এলাকার হয়তো রাস্তাঘাট খারাপ। সেই রাগগুলিও ভোট বাক্সে প্রতিফলিত হয়। আবার কেউ হয়তো স্থানীয় নেতার দ্বারা প্রচণ্ডভাবে উপকৃত। সেই কৃতজ্ঞতা বশত তাঁরা কোনও একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলকে ভোট দিয়ে থাকেন।
উপরের সবকটি যুক্তি ঠিক। আর এখানেই ভারতীয় নির্বাচন ব্যবস্থা মুখ্য উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে ভারতের সংবিধান প্রণেতারা যতই রাষ্ট্র পরিচালন ব্যবস্থায় জনগণের অংশগ্রহণের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিন না কেন, জনগণ সেই দায়িত্ব পালনের জন্য এখনও প্রস্তুত হয়ে ওঠেনি। কারণ তাঁরা একের পর এক নির্বাচনে নিজেদের নীতিগত অবস্থান নিয়ে উঠতে পারছেন না।
বিধানসভা এবং লোকসভা নির্বাচনে ভোটারদের অবশ্যই নীতিগত অবস্থানের ভিত্তিতে ভোট দেওয়া দরকার।
আরও খবর- Narendra Modi : বন্ধু নরেন্দ্র মোদীকে মিস করছেন ! – প্রধানমন্ত্রীকে রুশ সফরে আমন্ত্রণ পুতিনের
সব নির্বাচন কিন্তু নীতিগত প্রশ্নের হয় না। বিধানসভা এবং লোকসভা নির্বাচনে ভোটারদের অবশ্যই নীতিগত অবস্থানের ভিত্তিতে ভোট দেওয়া দরকার। কারণ তাঁদের ভোটের ভিত্তিতেই ঠিক হবে কে জিতবে আর কে হারবে। তার ভিত্তিতেই আগামী পাঁচ বছর দেশ ও রাজ্যের সরকার পরিচালিত হবে। আর একটি সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে নীতিগত অবস্থান খুব জরুরি। এখন ধরুন ২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বামেরা যদি হেরে যেত তাহলে তো আর রাজ্যে শিল্পায়নের ওই উদ্যোগটা শুরু হতো না। বরং তৃণমূল যদি জিতত তবে তারা ভারী শিল্পের বদলে ক্ষুদ্র শিল্পে বেশি নজর দিত। মানুষ ভোট দিয়ে ২০০৬ সালে সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার গঠন করেছিল বলেই না রাজ্যে শিল্পায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সিঙ্গুরের টাটাদের গাড়ি কারখানা তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল।
কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে পুরসভা এবং পঞ্চায়েত নির্বাচনে যে মানসিকতা এবং অবস্থান নিয়ে ভোট দেওয়ার কথা সেটাই আমজনতা লোকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচনে প্রয়োগ করে বসছে। আপনি কারোর থেকে ব্যক্তিগত সাহায্য পেয়ে কৃতজ্ঞ থাকুন বা এলাকার রাস্তাঘাট খারাপের জন্য ক্ষোভ থাকুক। সেটা পঞ্চায়েত এবং পুরসভার মতো স্থানীয় নির্বাচনে প্রয়োগ করাটা দরকার। কারণ এখানে নীতিগত প্রশ্ন নয়, বরং পরিষেবা বিষয়টি সরাসরি জড়িয়ে থাকে।
এই প্রতিবেদন যে প্রশ্ন তুলে শুরু হয়েছিল এবার তার শেষ পর্যায়ে এসে আমরা উপস্থিত। দেখা যাচ্ছে বাংলার জনগণ নিজেদের অবস্থানের প্রতি সৎ না থাকাতেই সিঙ্গুর সমস্যা আজ প্রবল জটিল আকার ধারণ করেছে। সিঙ্গুর থেকে টাটাদের কারখানা তো চলেই গেছে, কিন্তু সিঙ্গুর আর কৃষিকাজেও ফিরতে পারেনি। আসলে সিঙ্গুরের ওই জমির মতোই নীতিহীনতার কারণে বন্ধ্যা রাজ্যে পরিণত হওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ। এই নীতিহীনতা সরকারের নয়, এই নীতিহীনতা আমজনতার, এই নীতিহীনতা ভোটারদের। মানুষ শিল্পায়নের বিপরীত অবস্থানকে সমর্থন করবে ভোট বাক্সে এবং তারপর আশা করবে রাজ্যে প্রচুর শিল্পায়ন হবে, বেকাররা সকলে কাজ পেয়ে যাবে এই দুটো বিষয়ে একসঙ্গে হতে পারে না। জমি অধিগ্রহণের বিরোধিতা করে ভোটে জেতার পর তাদের নৈতিক কর্তব্য রাজ্যে ভারী শিল্প আনার দিকে ততটা নজর না দেওয়া। সেইদিক থেকে দেখলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচালিত সরকার কোনও ভুল করছে না। কারণ তাঁরা জনগণের রায়কে মর্যাদা দিচ্ছেন এবং সেটাই করা উচিত।
Singur : বাংলার ভোটারদের ভুলেই সিঙ্গুর জট!
আরও খবর- Job Vacancy : একাধিক পদে নিয়োগ করবে লাইফ ইনসিওরেন্স কর্পোরেশন
এখন বাংলার ভোটারদের বুঝতে হবে তাঁরা কী চান, আর যেটা চান সেটার প্রতি সম্পূর্ণ বিশ্বাস আছে কিনা। আসলে বিরাজনীতিকরণ ঘটে গিয়ে নির্বাচন ব্যবস্থাটাকে একটা খোলামকুচি, আঙুলে ভোটের কালি লাগিয়ে সেলফিতে পরিণত করে ফেলেছে বিরাট অংশের মানুষ ষ। আর তাই নীতিগত প্রশ্নের জায়গা দখল করে নিচ্ছে ব্যক্তিগত মামুলি চাওয়া পাওয়া, ক্ষোভ-বিক্ষোভ। যার কুফল ভোগ করছে শিক্ষিত তরুণ প্রজন্ম।