স্মৃতিপটে পুলওয়ামা- ১৪’র ভয়াবহ স্মৃতি আগলেই বদলেছে উপত্যকার ছবি…

শুভজিৎ চক্রবর্তী

বিকেল তখন চারটে। দিল্লির ঠান্ডার পারদ তখনও বাড়ছে। আগের রাতের বৃষ্টিতে আবহাওয়া কিছুটা বদলে গিয়েছে। বদলে যাওয়া দিল্লিতে আমাদের আস্তানা তখন লাল কেল্লার বিপরীতের বাসস্টপ। অপেক্ষা করছি বাসের। আমার সঙ্গে ছিলেন আমাদের নিউজহেড নয়ন রায়।

দিল্লির প্রবল ঠান্ডায় কুঁকড়ে গিয়েছে গায়ের সমস্ত লোমকূপ। পরের দিন যাওয়ার কথা ছিল পুঞ্চ। গত কয়েক বছরে জঙ্গি হামলায় সংবাদের শিরোনামে একাধিকবার উঠে এসেছে পুঞ্চের নাম। আমরা ছিলাম সুরানকোটের প্রাক্তন কংগ্রেস বিধায়ক চৌধুরী মহম্মদ আক্রম সাহেবের অতিথি।

হঠাৎ করে ফোনে মেসেজ টোন বেজে উঠল। নোটিফিকেশন সরিয়ে যা দেখলাম তা দেখে বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। দেখলাম একটা বিস্ফোরণে ৪০ জন সেনা জওয়ানের মৃত্যু হয়েছে। সেই ঘটনায় নড়ে গিয়েছে গোটা দেশ। এমনকি মুহুর্তের মধ্যে দিল্লির বেশকিছু জায়গায় হাই এলার্ট জারি হয়ে গিয়েছে। প্রথমে একটু সংকোচ করলেও শেষ অবধি ঠিক করলাম আমাদের গন্তব্যে যাবোই। কারণ কমিটমেন্ট ছিল।

রাত সাড়ে ৯ টায় বাসে চড়ে বসলাম। মনে সাহস থাকলেও মাথার মধ্যে অনেকগুলো বিষয় ঘুরে বেড়াচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ততক্ষণে তোলপাড় শুরু হয়েছে। শহীদ সেনা জওয়ানদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে শুরু করেছে গোটা দেশ। রাগে ফুঁসছে গোটা ভারতবর্ষ। ফুঁসছে উপত্যকা।

এতকিছুর মধ্যে কোনরকমে বাসের মধ্যে দুই চোখ বুজিয়ে ঘুম দিলাম। সকালে যখন ঘুম ভাঙল তখন ঘড়িতে বাজে সাড়ে ৬টা। ফোনের নেটওয়ার্ক তখন উড়ে গিয়েছে। বাসের জানালার পর্দা সরিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম কোথায় আছি। একটা পোস্টার দেখে বুঝলাম তখন পাঠানকোট।

গত দিনের ঘটনায় আজকের আবহাওয়ার মনভার। মেঘলা গুমোট আকাশ ধীরে ধীরে কাটিয়ে সুর্যের দেখা মিলল। ততক্ষণে আমরা জম্মু শহর থেকে খুব কাছে। জম্মু-কাশ্মীর তখন সন্ত্রাসবাদ হামলায় চোখ মুছছে। শহরের প্রত্যেকটি মোড়ে রয়েছে কেন্দ্রীয় বাহিনীর কড়া নিরাপত্তা। কোনও অঘটন না ঘটে যায়।

কেটে গেল ২ বছর, দমেনি প্রতিশোধের স্পৃহা, পুলওয়ামার স্মৃতি এখনও টাটকা….

শহরে প্রবেশ করতে পারল না যাত্রীবাহী বাস। আমরা তখন দিশেহারা। নতুন জায়গা। বড় একটা অঘটন ঘটে গেছে। হোটেল যেটা ছিল সেটা জম্মু বাসস্ট্যান্ডের কাছে। এখন আমাদের ভরসা শুধুমাত্র মানুষ। শুরু করলাম হাঁটা।

হঠাৎ করে দেখা হল এক অটোওয়ালার সঙ্গে। নাম পবন সিং। বলল যাবে স্ট্যান্ড। এমনকি হোটেলের ঠিকানাও নাকি সে জানে। এমনিতে কারোর নাম মনে থাকে না। তবে সেদিনের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমাদের কিছুদুর নিয়ে যাওয়ার পরে তিনিও বললেন আর যেতে পারবেন না। বললেন চার কিলোমিটার গেলেই মিলবে বাসস্ট্যান্ড।

যেতে যেতে দেখলাম শহরের একাধিক জায়গায় ততক্ষণে প্রতিবাদের কালো ধোঁয়ায় আকাশ ঢেকে গিয়েছে। মানুষের মধ্যে আক্রোশ জেগে উঠেছে। রাস্তায় নেমে এসেছে যুব সমাজ। হাতে তেরঙ্গা পতাকা, মুখে “পাকিস্তান মুর্দাবাদ” শ্লোগান। উপত্যকার রাস্তা অতিক্রম করে উপস্থিত হলাম তাওয়ী নদীর ওপর। উত্তপ্ত শহরের মধ্যে একাই যেন নিশ্চুপ সে।

রাস্তাজুড়ে চলছে মিছিল। এর আগে আমি মানুষের মধ্যে এতটা কখনও ক্ষোভ দেখিনি। এসব টপকে কোনরকমে বাইপাসের ধারে একটি হোটেলে উপস্থিত হলাম। ফ্রেশ হয়ে ঠিক করলাম আরও একবার পরিস্থিতি দেখার জন্য বের হবো।

ততক্ষণে জম্মু-কাশ্মীর পুলিশ মাইকিং করছে কার্ফু লেগে গিয়েছে। আমাদের যোগাযোগের একমাত্র উপায় ছিল হোটেলের ওয়াইফাই। তাও সাংবাদিক বলে কাকুতিমিনতি করার পর সেই সুবিধা পাওয়া গিয়েছিল।

তবুও জেদ। বের হতে হবেই। আমাদের পথ আটকালো নিরাপত্তার জন্য মোতায়েন থাকা কেন্দ্রীয় বাহিনী। আমার পিঠের ব্যাগ একজন চেক করলেন। একজন উচ্চপদস্থ অফিসারকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, “স্যার ইসকো ভেজে?” উত্তর এল, “জাহান সে আয়ে হেয় ওয়েহি পে ভেজ দো”। নির্দেশ মেনে আমরাও ফিরে গেলাম হোটেলে।

ততক্ষণে রাইসিনা হিলে ব্যাপক শোরগোল পড়ে গিয়েছে। তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং উপস্থিত হয়েছেন শ্রীনগরে। কান্নায় ভেঙে পড়েছে গোটা দেশ। বাইরে এখন নিরাপত্তারক্ষীদের বুটের শব্দ। সেইসঙ্গে চলছে কার্ফুর মাইকিং প্রচার। কেউ বাইরে বের হলেই তাঁর বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে জম্মু-কাশ্মীর পুলিশ। দুর্বিষহের সেই রাতে দু’ চোখের পাতা এক করতে পারিনি কেউই।

পরের দিন সকালে উঠে খোঁজ করলাম কোনও বাসে করে ফেরা যাবে কিনা। হোটেলে খবর এল কোনও বাস নেই। ততক্ষণে হোটেলের সঙ্গে কথা বলে আমাদের বিষয়ে অবগত করিয়েছেন চৌধুরী সাহেব। একাধিকবার ফোন করে আমাদের খোঁজ নিয়েছেন তিনি।

দুই দিন ধরে আটকে থাকার পর অবশেষে কলকাতায় সতীর্থদের সঙ্গে কথা বলে আমাদের টিকিটের ব্যবস্থা করা গেল। কিন্তু যাবো কিভাবে? আবার হাঁটা শুরু করলাম। এবারও আমাদের পথ আটকালো নিরাপত্তারক্ষীরা। জিজ্ঞাসাবাদের পর এক অফিসার নির্দেশ দিলেন এক পুলিশ অফিসারকে তাঁদের গাড়িতে করেই যেন আমাদেরকে পৌঁছে দেওয়া হয়।

বিকেল ৪ টে বাজে। তখন জম্মু স্টেশনে প্রচুর মানুষের ভিড়। সরানো হচ্ছে সেনা। আলাদা করে রয়েছে সেনার টহলদারি। এবার আর সোজা দিল্লি নয়। মধ্যরাতে অমৃতসর হয়ে সকালের ট্রেনে যাবো দিল্লি।

সেই ঘটনা পার করেছি দুই বছর। তবুও সেদিনের কথা এখনও মনে আছে। মনে রয়েছে তাওয়ি নদীর কথা। মনে রয়েছে সেই মহিলার কথা যিনি কলকাতার লোক বলতেই আশ্রয় দিয়েছিলেন। এখন অবশ্য সমস্ত পরিবর্তন হয়েছে। অনেকটা ঝড় সামলাতে হচ্ছে গোটা উপত্যকাকে।

সম্পর্কিত পোস্ট