শতাব্দী, প্রসূণের মানভঞ্জন হলেও ব্রাত্য রাজীব! ‘স্পষ্ট কথা’ই কী কাল ? প্রশ্ন কর্মীদের

সহেলী চক্রবর্তী

শনিবার ১৬ ই জানুয়ারি দুপুর তিনটে ফেসবুক লাইভে বসেছিলেন রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়। সেদিনের সেই লাইভ থেকে রাজ্যের কর্মসংস্থান, যুবকদের রাজ্য ছেড়ে চলে যাওয়া, দলের মুষ্টিমেয় কয়েকজন নেতার কর্মীদের প্রতি দুর্ব্যবহার সহ তার নিজের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার বেশ কয়েকটি কথা তুলে ধরেছিলেন তিনি।

সেই মন্তব্যে আপাদমস্তক কোথাও নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে কোনো ক্ষোভ ছিল না। বরং রাজীবের গলায় শোনা গিয়েছিল মমতা বন্দনা। সেদিন তিনি বলেছিলেন দলনেত্রীর দেখানো পথ এবং আদর্শেই তিনি এতকাল চলেছেন। যখন তাকে যে দায়িত্ব দেওয়া হোক না কেন সেই দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন বা সম্পূর্ণভাবে করতে না পারলেও আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন।

এরপরেই রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য নিয়ে জল ঘোলা শুরু হয় বঙ্গ রাজনীতির আলোচনায়। শাসক দলের বর্ষীয়ান সাংসদ সৌগত রায়, রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই মন্তব্যকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। একইসঙ্গে তিনি প্রশংসা করেছেন রাজীবের জনকল্যাণমুখী এই চিন্তা-ভাবনার।

তবে শাসক শিবিরের আরেক নেতা ফিরহাদ হাকিম রাজীবের এই মন্তব্যকে সাধুবাদ জানানো দূর, উল্টে সরব হয়েছেন কেন তিনি ফেসবুক লাইভে এই সমস্ত কথাগুলো বললেন। ফিরহাদ হাকিমের কথায়, বিজেপির গ্যাস খেয়েছে। রাজীব বাচ্ছা ছেলে। তাই এইসব কথাবার্তা বলছে।

এই জায়গাতেই রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের প্রশ্ন, রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় কি সত্যিই বাচ্ছা ছেলে?  তার কী রাজনৈতিক বুদ্ধি এতটুকুও পরিপক্ক হয়নি? যদি নাই হয়ে থাকে, তাহলে কালিয়াগঞ্জ এবং করিমপুরের মত দুটো টাফ সিটে কিভাবে জয় ছিনিয়ে আনলেন? কিভাবেই বা বিপ্লব মিত্র বিজেপিতে চলে যাওয়ার পর দক্ষিণ দিনাজপুরের মাটি সাংগঠনিক দিক থেকে মজবুত করে তুললেন?

তাদের আরও প্রশ্ন, কীভাবেই বা চৈতন্য প্রভাবিত নদীয়ায় পর্যবেক্ষক থাকাকালীন গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব শব্দটিকে ডিকশনারির বাইরে করে দিলেন? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যন্ত সেই সময় রাজীবের দুর্দমনীয় মনোভাবকে প্রশংসা করেছিলেন।শাসকশিবিরের আরেক সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্দেশেও তাদের প্রশ্ন, কীভাবে তিনিও ভুলে গেলেন তার সাংসদ হওয়ার পরোক্ষে রাজীবের ভূমিকা?

শনিবারের পর কেটে গিয়েছে ৪৮ ঘন্টার বেশী সময়। মঙ্গলবার রাজীব ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গিয়েছে,  এখনো পর্যন্ত দলের কেউই তার সঙ্গে আলোচনায় বসার কোনরকম প্রস্তাব দেননি। শুধু তাই নয় বেসুরো রাজীবকে নিয়ে যে অস্বস্তিতে দল রয়েছে সেখান থেকে রাজীবকে ছন্দে ফেরানোর কোনো উদ্যোগও তাদের নিতে দেখা যায়নি।

রাজনৈতিক মহলের মতে, শাসক শিবির ধরেই নিয়েছেন রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় দলবদল করছেন। কিন্তু তা সত্বেও কেন তাঁর ক্ষোভ প্রশমনের চেষ্টা করল না দল? যেখানে বীরভূমের তারকা সাংসদ শতাব্দী রায় সুর বদলের ২৪ ঘন্টার মধ্যে সমস্যার সমাধান পেয়ে গেলেন। বৈঠক করলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। সুরে ফিরে পুরস্কার হিসেবে পেলেন রাজ্যের সহ সভাপতির পদ। সেখানে ব্রাত্য থেকে গেলেন রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়।

“আমি ধৈর্য্যের পরীক্ষা দিচ্ছি, আমার ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটেনি”- কীসের ইঙ্গিত দিলেন রাজীব?

অন্যদিকে হাওড়ার সাংসদ এবং দাপুটে ফুটবল প্লেয়ার প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় মনের দুঃখ প্রকাশ্যে আনার পর তার সঙ্গে বৈঠকে বসলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায। তাহলে রাজীবের সঙ্গে কেন বৈঠক করা হলো না? এ প্রশ্ন তুলছেন হাওড়ার শাসক শিবিরেরই একাংশ।

হাওড়ায় শাসক শিবিরের কর্মীরা দ্বিধা বিভক্ত। দক্ষ সংগঠক এবং স্বচ্ছ ভাবমূর্তির অধিকারী হিসেবে রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়কে সমস্ত নেতৃত্বদের থেকে এগিয়ে রাখেন তাদের একাংশ। পাশাপাশি দল রাজীবের সঙ্গে যে দূরত্ব তৈরি করছে সেটাও মেনে নিতে পারছেন না অনেকে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেতার কথায়, দলনেত্রী গৌতম দেবের সঙ্গে ফোনে কথা বলে সমস্যা মেটালেন। রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও টেলিফোন মারফত বা সামনাসামনি আলোচনা করতে পারতেন। তাতে বরফ গলতে বাধ্য হতো।

তার কারণ ২০১১ সালের পালাবদলের পর থেকে তৃণমূলের যুব সংগঠনের আইকন হয়ে উঠেছিলেন রাজীব। অন্যান্য নেতৃত্বরা সেখানে থাকলেও রাজীবের গ্রহণযোগ্যতা ছিল সর্বাগ্রে। সব থেকে বড় কথা তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই। বিরোধীদল যতই শাসক শিবিরের নেতৃত্বদের নিশানা করুন না কেন আজ পর্যন্ত রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে কোনো রকম মন্তব্য করার সাহস তারা দেখাননি।

২০২০ সালে দুর্গাপুর ব্যারেজের লকগেট ভাঙার পর সেখানকার আমজনতা বারবার রাজীবের নাম করছিলেন। তার কারণ সেচমন্ত্রী হিসেবে রাজীব চূড়ান্ত সফল। শুধু তাই নয় তার আমলে সেচ দফতরের প্রচুর কাজ সমাপ্ত করা সম্ভব হয়েছিল।

যদিও হঠাৎই তাকে সরিয়ে দেওয়া হয় সেচ দফতর থেকে। দায়িত্ব দেওয়া হয় শুভেন্দু অধিকারীকে।তারপর অবশ্য সেচ দফতরের নাম সেভাবে কোথাও সগর্বে উঠে আসেনি। সেচ দফতরে কর্মরত আধিকারিকরা বলছেন, রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় মন্ত্রী থাকাকালীন বিভিন্ন জায়গায় নতুন করে পরিকল্পনা গ্রহণ করার চেষ্টা করেছিলেন। যেখানে গলদ রয়েছে সেই রিপোর্ট তুলে ধরেছিলেন।  সেই সমস্ত কাজ তিনি মন্ত্রিত্ব ছেড়ে যাওয়ার আড়াই-তিন বছর পরেও করে তোলা সম্ভব হয়নি। তার জ্বলন্ত উদাহরণ দুর্গাপুর ব্যারেজের ৩১ নম্বর লকগেট ভাঙার ঘটনা।

সুরে বাজলেন শতাব্দী, ‘বেসুরো’ রাজীবকে নিয়ে নাভিশ্বাস তৃণমূলের

একইসঙ্গে তাদের কথায়, সেচ দফতরে থাকাকালীন ছদ্মবেশে রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় বালি পাচারকারীদের ধরেছিলেন। ফলে তাদের রমরমা সেই সময় রোধ করা সম্ভব হয়েছিল। বনমন্ত্রী হয়ে আসার পর বনজ সম্পদ চুরি বন্ধ করতে তার ভূমিকা অনস্বীকার্য। প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রেখে অবলা জীব জন্তুদের ভালো-মন্দের যে গুরুদায়িত্ব রাজীবের কাঁধে রয়েছে সেই দায়িত্ব পালনে কখনো কোনো রকম ফাঁক রাখেননি তিনি।

রাজীব ঘনিষ্ঠ এক নেতার কথায় মন দিয়ে নিজের কাজ করাটা কি অন্যায়? নাকি নিজের সেরা পারফর্মেন্সটা দেওয়া ভুল? নাকি দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব হওয়া উচিত নয়? বা যারা দুর্নীতি করছেন তাদের বিরুদ্ধে সর্বসমক্ষে প্রতিবাদ জানানো ঠিক নয়? এর উত্তর আমাদের জানা নেই।

ওয়াকিবহাল মহলের মতে, সাংগঠনিক দিক থেকে রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে ক্ষুরধার বুদ্ধি বর্তমানে যারা শাসক শিবিরের শীর্ষ নেতৃত্বের তালিকায় রয়েছেন তাদের কারোরই নেই, একথা হলফ করে বলা যায়। সংগঠনকে চাঙা করে কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করে নেতা থেকে কর্মী হয়ে কিভাবে দলকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় ম্যানেজমেন্ট পাশ করা ছাত্র রাজীব সেটা খুব ভাল করেই জানেন। তার মার্কশিটে একের পর এক সাফল্য থাকলেও যোগ্য সম্মান বা তাকে নিয়ে দলের কোন ভাবনা চিন্তা সেই অর্থে চোখে পড়ল না।

অন্যদিকে গেরুয়া শিবিরের তাবড় শীর্ষ নেতৃত্বরা মুখিয়ে রয়েছেন রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত ‘ক্লিনফেস’ তরুণকে নিজেদের শিবিরে টেনে নেওয়ার জন্য। এতে তরুণ প্রজন্ম, যারা রাজনীতিতে রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়কে অভিভাবক হিসেবে মানেন তাদের সমর্থন আদায় সম্ভব হবে। পাশাপাশি রাজীবের সাংগঠনিক বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে এ রাজ্যের বুকে বিজেপির জমি শক্ত করা আরও সহজ হবে। শুধু তাই নয় ক্লিনফেস রাজীবকে আগামী দিনে বড় কোন গুরু দায়িত্ব দিতে পারে গেরুয়া শিবির।

নির্বাচনের আর হাতে গোনা কয়েক দিন বাকি। এখনো পর্যন্ত দ্বিধা-বিভক্ত শাসক শিবির। বলা যেতে পারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে দিশাহীন অবস্থায় রয়েছেন তা নন্দীগ্রামের বক্তব্য ভাল করে শুনলেই বোঝা যাবে। যতই তিনি পদ দিয়ে ছন্দহীন নেতাদের ধরে রাখার চেষ্টা করুন না কেন, তাতে বিশেষ লাভ হবে না। এই মরিয়া চেষ্টা যদি রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে একবার অন্তত করা হত তাহলে আখেরে দলেরই লাভ হতো।

শাসক শিবিরের নিশানায় হাওড়ায়, জল মাপছেন রাজীব !

রাজনৈতিক মহলের মতে,  যদি সত্যিই রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় আগামী দিনে জনগণের জন্য কাজ করার উদ্দেশ্য নিয়ে রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম বদল করেন তাহলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। তাতে হয়তো অনেকেই তাকে ‘বেসুরো’ , ‘বেইমান’ বা ‘মির্জাফর’ বলে আক্রমণ শানাবেন। তাতে অবশ্য তেমন কোনো ক্ষতি হবেনা। কারণ জনগণ যথেষ্ট বিচক্ষণ।

কে বলতে পারে, হয়তো ১০ বছর পর ফের পরিবর্তনের পরিবর্তন দেখতে চলেছে এই বাংলা !

সম্পর্কিত পোস্ট